সংরক্ষণ যখন সঙ-রক্ষণ
ফুটবলের মরসুম। এই
মরসুমে একটা ফুটবলীয় জোক ভাঙা যাক। যদি ভারত কোনোদিন ফিফা বিশ্বকাপে খেলার
যোগ্যতা অর্জন করে, তাহলে তারমধ্যে তিনজন শিডিউল্ড ট্রাইব
স্ট্রাইকার, দু’জন
ও.বি.সি.(এ) উইঙ্গার, দু’জন
ও.বি.সি.(বি) মিডফিল্ডার, তিনজন শিডিউল্ড কাস্ট ডিফেন্ডার এবং
একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী গোলকিপার পাঠানো হবে। কি বাজে জোক, তাইনা? সবথেকে
বড়ো বিষয়, জোকটা
যতটা না ফুটবলীয়, তার
থেকে কয়েকগুণ বেশী সংরক্ষণীয়!
সংরক্ষণ ব্যবস্থার উৎস অনুসন্ধানে গেলে বহু পিছনে
যেতে হবে। রামায়ণ-মহাভারত
ঘাঁটলে দেখবেন,
নিম্নকুলজাত হওয়ার কারণে একলব্য
দ্রোণাচার্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে পারছে না, সূতপুত্র হওয়ার
কারণে কর্ণকে ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে ইত্যাদি। আর্য-অনার্য ভেদাভেদের সাথে সাথে
ছিল ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়দের দাপাদাপি। ছিল
অচ্ছ্যুৎমার্গ। এসব
চলে আসছে
বহুকাল ধরে। এমনকি
ইউরোপ-আফ্রিকাতেও নিগ্রো অত্যাচার-একই ছবি। এসবের বিরুদ্ধে
রুখে দাঁড়ালেন আব্রাহাম লিঙ্কন, দেশে কিছুটা গান্ধীজী। গান্ধীজী মেথর সম্প্রদায়ের
নাম রাখলেন “হরিজন”। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দলিত সম্প্রদায়ের
প্রতিনিধি বি.আর.আম্বেদকর বহুকাল ধরে অবহেলিত-পিছিয়ে পড়া-অনুন্নত
শ্রেণীকে এগিয়ে আনার জন্য সংবিধানে বেশকিছু পরিকল্পনা রেখে গেলেন, যার
উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক।
সময়ের সাথে সাথে আম্বেদকরের পরিকল্পনারা রূপায়িত
হওয়ার যথাযথ পরিবেশ পেল। রাজ্যে
নকশাল আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে উচ্চবর্গীয় ব্রাহ্মণদের প্রভাব হ্রাস
পেল। আইনের সাথে সাথে
দেশজুড়ে মানুষের
মানসিকতা আরো উদার হল। যার
ফলস্বরূপ শিক্ষাক্ষেত্রে-চাকরিক্ষেত্রে
ব্যাপক অকুলীন মানুষের সুযোগ ও সম্ভাবনার দরজা খুলে গেল।
কিন্তু ধীরে ধীরে এর কুফলগুলিও নজরে আসতে
থাকলো। সংরক্ষণ
ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়াল রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার। স্বাধীনতার ৬৬ বছর পরও অনগ্রসরদের উন্নত
তো করা গেলই না, বরং
তা উত্তরোত্তর
বেড়ে চলেছে। এর
সবথেকে বড়ো কুফল মিলছে যোগ্যতার অবমূল্যায়নে। আজ একজন যোগ্য জেনারেল(অগ্রসর) যেমন
কোটার(সংরক্ষণ) কারণে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি একজন যোগ্য
অনগ্রসরকেও শুনতে হচ্ছে, “ও তো কোটায় কেটেছে”! একজন দরিদ্র
জেনারেল কেন ভাতা বা সরকারী অনুদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তার
কোনো সদুত্তর
নাই।
সংরক্ষণ কেবলমাত্র আইনের রূপায়ণে নয়, মানসিকতা
গঠনেও প্রভাব ফেলছে। অনগ্রসরেরা
ভেবে নিচ্ছে এতটুকু পড়লেই চাকরী পাকা অর্থাৎ তার বেশী না এগোলেও চলবে; অগ্রসরেরা
নিজেদের ব্যর্থতার দায় চাপাচ্ছে “কোটা সিস্টেমের” ওপর। এগুলো মোটেই কাম্য নয়। “নারীরা পুরুষদের সমকক্ষ” বলা হলেও
ট্রেনে মহিলাদের জন্য আলাদা কামরা রাখা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকারের
পরীক্ষায় মেয়েদের ফি-মকুব করা হচ্ছে আইনের আওতায়। আমাদের মানসিকতাতেও তৈরি হচ্ছে “দ্বিরাচারিতা”। বহুকাল ধরে বৃহন্নলা সম্প্রদায়কে
দূরে সরিয়ে রাখার পর আজ যদি তাদের সংরক্ষণের আওতায় আনা হয়, তবে
রাষ্ট্র এবং আমরা উভয়ই দোষী হব। কেননা
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোনো এক শ্রেণীর নাগরিকদের অবহেলা করা যতটা
দোষের, কোনো
শ্রেণীকে অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়াও ততটাই দোষের।
এসব কারণেই সংরক্ষণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে সঙ-রক্ষণ।তাহলে এর সমাধান কি? আপাতত
কাগজ দিয়ে যে ফাটল
আটকানো হচ্ছে, তা
নস্যাৎ করে আরো গভীরভাবে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। অনুন্নতরা আজও অনুন্নত। তাদের একই দায়রার মধ্যে এনে যোগ্য করে
তুলতে হবে, সবার
সাথে প্রতিযোগিতার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। হ্যাঁ, এজন্য
তাদের উৎসাহ দিতে হবে, কিন্তু সুবিধা নয়। উপহার দেওয়া নয়, তাদের
যোগ্যতার
সাথে অর্জন করতে শেখাতে হবে। তবে তার আগে আমাদের নিজেদের মানসিকতা বদলাতে হবে, বন্ধ করতে হবে ভোটব্যাঙ্ক বাঁচিয়ে রাখার জন্য অনুন্নতদের উন্নত করার নামে সস্তা ভণ্ডামি, হাত লাগাতে হবে ঋজু দেশ গড়ার কাজে।
সাথে অর্জন করতে শেখাতে হবে। তবে তার আগে আমাদের নিজেদের মানসিকতা বদলাতে হবে, বন্ধ করতে হবে ভোটব্যাঙ্ক বাঁচিয়ে রাখার জন্য অনুন্নতদের উন্নত করার নামে সস্তা ভণ্ডামি, হাত লাগাতে হবে ঋজু দেশ গড়ার কাজে।
কে হাত লাগাবে? এই প্রবন্ধ পড়ার পর কোনো
তফসিলি পাঠক বা পাঠিকা যারা বর্তমানে সংখ্যাগুরু, তারা কি আদৌ এ বিষয়ে
ভাববে? না, মোটেই
না। সুবিধা নিতে কে না
চায়! দেশের
কথা কে ভাবে! আপনি বাঁচলে বাপের নাম! প্রবন্ধকার নিজে
ব্রাহ্মণ-পদবীধারী বলে এসব হিজিবিজি লিখেছে। আর
তাছাড়া এতকাল
ওরা আমাদের অবহেলা করেছে, এবার তো আমাদের পালা! ব্যাস, এই মানসিকতার
জন্যই তো একশো কুড়ি কোটির দেশ হয়ে আজও আমরা ফুটবল নিয়ে চায়ের কাপে
ঝড় তুলি, অথচ
মাত্র এগারোজন ফুটবলার বানাতে অক্ষম!
সুমন্ত চ্যাটার্জী, কাটোয়া, বর্ধমান।
সুমন্ত চ্যাটার্জী, কাটোয়া, বর্ধমান।
কোন মন্তব্য নেই