রেবতী / দীলতাজ রহমান
পাত্রীপক্ষের আগ্রহ বেশি থাকলেও দু’পক্ষের বোঝাপড়ায় রম্নবিনা এ বাড়ির বউ
হয়ে এলো। রাকিব হলো ওদের বাড়ির জামাই। কিন্তু শুধু বউকে শ্বশুরকূলের সব কথা শুনতে হবে?
জামাইকে একটুও নয়? এত বড় বাড়ির মেয়ে রম্নবিনা, অথচ এখানে মাত্র একখানা ঘরের সে দখলি!
কোথাও একটু সাজিয়ে-গুছিয়ে মনের মতো করে রাখার পরিসর নেই। রঙচটা সব ফার্নিচার, আর নীতিকথার
কচকচানি! কতকাল চলবে এই অসহনীয় দশা? নিজের সঙ্গে ক’মাস যুঝে ঘূর্ণাবত তাড়নায় অপূর্ণ
শ্রী’র সংসার থেকে রাকিবকে ধ্বসের মতো টেনে সুখসাগরে অথৈ হতে চায় রম্নবিনা। শ্বশুরের
কেনা মাঝারি গোছের ফ্ল্যাটটি থেকে দূরে, নিজের স্বপ্নআঁকা অলিন্দের সুরম্য কোনো বাড়িতে।
রম্নবিনার প্রেমে কেউ-ই হাবুডুবু খায়নি। বাবা বড়লোক। মেধারও কমতি ছিলো না। ইদানীংকালের
আর্ট-কালচারের স্রোতও তার রক্তে মিশে আছে। তবু হয়নি। হয়তো হয়েছিলো অন্যরকম। কিন্তু যে
সম্পর্কের রেশ বিয়ে পর্যন্ত ভাবায় তেমনটি হয়নি।
রাকিবের সঙ্গে রম্নবিনার পরিচয় ছিলো অনেক দিনের। তাও কোনো আত্মীয়ের ঘনিষ্ঠ
পরিচিতজন হিসেবে। মেয়েটির লেখাপড়ার পাঠ শেষ। চাকরি বাকরি খুঁজছে। পেলে হবে গোছের আড়মোড়া
পাকিয়ে বসে থাকা মেয়েটির বয়স বেড়ে যাচ্ছে বলেই যে ক’জনকে পাত্র হিসেবে পাকড়াও করা যায়,
ক্রমান্বয়ে রাকিব ওদের তেমনই একজন হয়ে ছিলো। প্রস্তাবটি রকমফেরে এক এক করে শেষপর্যন্ত রাকিবকে দেয়া হলে, কিন্তু, কিন্তু... করে কথাটি ধরে রেখে অপছন্দের দিকটি তখনি ব্যাখ্যা
করতে পারছিলো না রাকিব। ‘মেয়েটি সুন্দর, শিক্ষিত, রুচিশীল, পরিবারটি বিত্তবান হলেও
মূল্যবোধে মধ্যবিত্তের ধব্জা ধরে আছে। এটাও ভালো লাগে। কিন্তু কেন যেন আমার মেয়েটিকে
ভালো লাগে না। ভেবেছিলাম কখনো ভালোলেগে গেলে তোমাকে বলবো।’ মাকে ডেকে একবেলা ঝেড়ে গল্পের
মতো মেয়েটির প্রসঙ্গে কথাগুলো বলেছিলো রাকিব। মজা করার জন্যই বলা। কিন্তু গলগলে গল্পটি
মায়ের চোখ খুলে দিয়েছিলো।
বলার ধরন যেমনই হোক, রেবতী ভাবলেন, ‘নিজের বিয়ের কথা ছেলে যখন তুলেই ফেলেছে
এমনি দ্বিধাহীন ভাবে। তখন আর অপেক্ষার অবকাশ থাকে না। বরং আরো আগেই আমাদের বোঝা উচিৎ
ছিলো।’ রেবতী খুব কাছে থেকে না দেখে থাকলেও কখনো সখনো, এখানে-ওখানে এক আধটু দেখার শান্ত-ভদ্র,
ফর্সা মাঝারি গড়নের রম্নবিনাকে সংসারের প্রতিটি পঙ্ক্তিতে সাজিয়ে দেখতে দেখতে নিজের
প্রাণটি কবিতার মতো পুনারাবৃত্তিতে এমনি ভরে ফেললেন যে, এখন তাকে সরিয়ে রাখলে স্বপ্নভঙ্গের
শূন্যতা ছাড়া কিছু থাকে না সে প্রাণে। ছেলের বিয়ের পক্ষে স্ত্রী’র যুক্তি গ্রহণ করে
ভাবতে লাগলেন ফয়জুল ইসলামও।
ক’দিন না যেতে একদিন ছুটির দুপুরে ছেলের পাশে বসে ভয়-উৎকণ্ঠা আর আগ্রহের
মিশ্রস্বরে জানতে চাইলেন রেবতী ‘হ্যাঁরে বাবা, ওরা তোর সঙ্গে ঠাট্টা করেনি তো? কথাগুলো
বলে আবার একটু পিছিয়ে যান কণ্ঠে স্বর নামিয়ে। কারণ ছেলেকে নিজেই প্রশ্রয়ে মুরম্নব্বি
সাজিয়ে রেখেছেন। তাই ক্ষেপে তাড়া দিয়ে সরিয়ে দেয় যদি! কথা বলতে মায়ের দৃষ্টিতে হেমন্তের মেঘ-রোদকাশ ভাসতে দেখে রাকিব বিস্মিত হলো। গায়ে জড়ানো নকশাতোলা কাঁথাখানা থেকে নিজেকে
টেনে ছাড়িয়ে মুখোমুখি বসলো তিড়িং করেই। তারপর বললো, ‘কী ব্যাপার তোমাকে খুব ম্যাচিউরড
লাগছে মা! মনে হচ্ছে, শাশুড়ি হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছো। তা কি যেন বলছিলে মা?
-ওই যে... রম্নবিনা...।
-ঠাট্টা ভাবছো কেন? নিজের ছেলে সম্পর্কে তোমার এই ধারণা?
-না... ওদের তো ঢাকায় নিজেদের দু’তিনটে বাড়ি, গাড়ি... তোর বাবা তো তেমন
কিছু করেননি!
-চিন্তাভাবনায় তুমি এত দুর্দশাগ্রস্ত মা! তুমিও ওই রম্নবিনা নাকি ছবিনা
ওরই মতো। যাও তো তুমি গিয়ে টিভি খুলে সিনেমা দেখো গিয়ে। দেখো কোন চ্যানেলে উত্তম-সুচিত্রা
হচ্ছে। ওহ্, তোমার নায়িকা তো সুপ্রিয়া! যাও, তাকেও কোথাও না কোথাও পাবে!
-তুই কী যেন বলছিলি? আমি কার মতো?
-মানে? ওই মেয়ের সবই আছে, কিন' ওর বড় দৈন্য সে উচ্চাভিলাষী নয়। উদ্যমী নয়।
একবারে ম্যাড়মেড়ে। ওকে যে বিয়ে করবে তার লাইফটা নরকে পরিণত হবে। মা গো ওইসব মেয়েরা
তাই করে! অন্যের জীবন নরকে পরিণত... উহ্, পরীক্ষার পাশের সার্টিফিকেটগুলো ন্যাপথলিনে
পেঁচিয়ে, লম্বা লম্বা নখ রেখে সারাক্ষণ তা ঘষে ঘষে পলিশ করে। আর সমান অধিকারের বুলি
কপচায়। এদের যারা সখি তারাও সব ওইরকম। নিজেদের রূপেগুণে এরা নিজেরাই এতো বুঁদ, যার
দরম্নণ নিজেকে ভেঙে গড়ার প্রেরণাটা এদের কখনো আসে না! সে তো তুমি বোঝোই! নাকি বলো মা?
রেবতী কিছুটা মারমুখি হয়ে তেড়ে গেলে, রাকিব দু’হাত উঁচিয়ে আত্মরক্ষার ভানে দেয়ালে পিঠ
ঠেকায়। কিন' যা বলার বলেই যায়, এরা কোথাও নিজেকে খাপ খাওয়াতে না পেরে সে ঝালও স্বামীকে
ঝাড়ে! আমার ঢের দেখা আছে মা! বাইরের কাজ কেন, ঘরেও একবেলা কাজের লোক ছাড়া চালিয়ে নেবার
যোগ্যতা রাখে না। স্বামী বেচারিরা আবার হেঁটে হেঁটে কাজের মানুষ খুঁজতে বেরোয়। আমি
অতো ভালো স্বামী হতে পারবো না...। উহ্, ভাবা যায় এমন এক একজন মেয়ে মানুষকে সঙ্গ দিতে
স্বামীকে দুনিয়ার সব জ্ঞান ও আনন্দের রসদ বাইরে ফেলে অফিস ছুটির আগে দৌড়ে বাড়ি ফিরতে
হয়। খালি স্ত্রী’র তুলকালাম কা- বাঁধানোর ভয়ে, নিজের গা বাঁচাতে। যার কাছে কোনো আলো
নেই, ধার নেই শুধু একঘেয়ে শারীরিক উষ্ণতা ছাড়া।
রেবতীর চোখ এবার লজ্জায় নিভে আসতে চায় ছেলের কথা শুনে। এত সহজে এমন কথা
মায়ের সামনে কেউ বলতে পারে! রেবতী জানেন অতো স্মার্ট মা তিনি নন। ছেলেকে নির্লজ্জ ঠাউরে
কঠিন কিছু বলার ভাষা তার জানা নেই। এ নিয়ে বাদানুবাদ করতে পারলে ভালো হতো। কিন' নীরবে
নিভৃতে তিনি সয়ে সয়ে অনেক দুর্লভ বোধ অর্জন করলেও প্রকাশের জড়তা কাটাতে পারেননি। এখন
নিজেকেই তার ছেলের ঘরে অনাহূতের মতো মনে হচ্ছে। তিনি অসারকণ্ঠে বললেন, মায়ের কাছে সংযত
হয়ে কথা বলতে হয়!
-‘তুমি বুঝি সেই মা! তুমি এত কিছু বোঝো মা, যার ধারেকাছে আমি পৌঁছুতেও পারবো
না। কিন্তু সত্যি এই, মা-কেই এসব কথা জানতে হবে। তাহলে তার মেয়েটি তিনি সেভাবেই তৈরি
করবেন। আরেকটি ছেলেকে সে ধারণায় উদ্বুদ্ধ করতে পারবেন। এসব কথা মায়ের জানাটা খুব প্রয়োজন।’
-ও সব তোর মনগড়া কথা। মেয়েটি এমএ পাস শুনেছি। এ সময়ে সব মেয়েই সব গুণ আয়ত্তে
রাখে...।
-তোমার ভাইয়ের বউটিও তো এমএ পাস। অথচ প্রাইমারিতে পড়া বাচ্চার জন্যও দু’জন
মাস্টার রাখতে হয়। মাছ কুটতে মামাকেই বসতে হয়। ও মেয়ে মামীর চেয়ে বেশি কিছু না মা!
মামার মতো বাচ্চার হিসি করা কাঁথা আমি ধুতে পারবো না।
-তোর মামী কি সুন্দর করে সংসার গুছিয়ে রাখে, এটাও অনেক বড় গুণ..। যা আমি
পারি না।
-অতো গোছানো ঘর দেখলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে, যেন খোয়াড়! বন্দি বাঘের অস্বস্তিতে ভুগি আমি। সংসার থাকবে হরিণের অভয়ারণ্যের মতো। তছনছ পদচারণা...।
-ফাঁকিবাজির জায়গা পেয়েছিস আমাকে, না? ওঠ ঘর গোছা...। আর ও মেয়েকে আমি সব
শিখিয়ে নেবো, দেখিস! তা ছাড়া শোন, ওদের থেকেও আমাদের শেখার অনেক কিছু আছে। সমন্বয় যে
ঘটাতে জানে তার কোথাও বাধে না রে। ওটুকু অনত্মত আমি পারি। আর যেকোনো কাজ পারা না পারা
কোনো বড় বিষয় নয়। প্রয়োজনেই মানুষকে শেখায়!
-ভুল বললে মা, আমার ভয়টা তো সেখানে। ও এসে তোমাকে আগে তাড়ানোর পাঁয়তারা
করবে। যখন দেখবে প্রয়োজনগুলি তোমাকে ছাড়া মিটছে না। ওরা প্রয়োজন তৈরি করতে চায় ওদের
মতো।
-তুই এত কিছু কবে শিখলি রে খোকা?
-দেখে দেখে, মা দেখে দেখে! এইসব সুনসান বাড়িগুলোতে কি ভাঙন টলেছে তুমি তা
বুঝবে না। কারণ তুমি নিজেই সব ভাঙন ঠেকিয়ে রাখতে শিখেছো। দেখেছি না কী কসরত তোমাকে
করতে হয়েছে বেহাল সংসারটি নিয়ে। এই অবস্থা তো আর একদিনে আসেনি!
-কতটুকু দেখেছিস্ তুই? আগেই একটা মনগড়া ধারণা তৈরি করে তার মধ্যে সেঁধিয়ে
আছিস? তোর বাবার অবস্থা তো কখনো খারাপ ছিলো না!
-আচ্ছা মা আমি কি তোমার চেয়ে খুব বেশি বছরের ছোট? ক’বছর হলো তুমি এ ফ্ল্যাটটি
পেয়েছো? আগে কী অবস্থায় ছিলাম আমরা?
-বড় বড় কথা বলিস না তো? খালি মনগড়া কথা... বাপের মতো...।
-আমার বাবার মতো ভালো মানুষ তুমি পাবে না মা! ওরা কি এসে তোমাকে ঘুষটুষ
দিয়ে গেছে নাকি, আমার সন্দেহ হচ্ছে!
-ও মেয়েকে তো আমি সামনাসামনি দেখিইনি! তা ছাড়া এইসব মনগড়া ধারণা ভবিষ্যতে
নিজের ক্ষতি ডেকে আনে। পরে এমন জায়গায় গিয়ে পড়বি...।
-শোনো মা, এইসব ভাবনা তাড়াও তো। সংসারে সচ্ছলতা আসুক...।
-সংসারে সচ্ছলতা আসে না সবার। কারো কারো শুরুর দিনই শেষ পর্যন্ত গড়ায়।
তাই বলে কি তাদের ছেলের বিয়ে বন্ধ থাকবে? চাকরিও তো খারাপ করছিস না।
-তুমি কি ভেবেছো বউ এনেও আমাকে এই স্টোর রুমে রেখে দেবে? স্কুলজীবনে যেখানে
ঢুকিয়েছো দরজা-জানলায় মনভোলানো পর্দা দিয়ে?
-তা কেন, আমি আর তোর বাবা এ ঘরে চলে আসবো। আমাদের ঘরটা তোদের দিয়ে দেবো।
এই তো নিয়ম! শামীম, তুহিনা ওরা ওদেরই মতো থাকবে। কারণ ওদের ঘর ওরা ছেড়ে দিতে নারাজ।
যে বউ হয়ে আসছে সে কতবড় ঘরের মেয়ে! দেখিস ওকে আমি পুতুলের মতো যত্ন করে রাখবো...।
-যত্ন করে রাখবে মানে? বউ-ই তো শাশুড়ির যত্ন করে বলে জানি। তুমি আসলে পাগল
হয়ে গেছো মা। এখন যাও তো আমি একটু ঘুরেটুরে আসি। ফিরতে রাত হতে পারে। ফোন না করতে না
পারলে চিন্তা করো না। মাকে হাত ধরে টেনে বাইরে রেখে দরজা বন্ধ করে শার্টপ্যান্ট পাল্টে
রাকিব বেরিয়ে পড়ে।
ত্রিশ ছুঁই ছুঁই রাকিবুল ইসলাম কথাবার্তা চিন্তাচেতনায় যেমন স্বচ্ছ তেমনি
সাবলীল। প্রতিটি পদক্ষেপ যেন নিজের স্বাতন্ত্র্যের ধ্বনি ফোটায়। সবারই একটা সমীহভাব
তাকে ঘিরে থাকে। অফিসে ডাইরেক্ট বসের কাছে তার অবস্থান ঈর্ষণীয়। সহকর্মী মেয়েগুলো এমনভাবে
তাকায়, যেন তাদের মাস্টার মশাই। কিন' ভীষণভাবে বৈষয়িক রম্নবিনার বাবা পাত্র হিসেবে
রাকিবের এক-আধটু খোঁজ নিয়ে সার্বিক অবস্থা যা ভেবেছিলেন-পাত্রপক্ষই এগিয়ে আসবে। কিন্তু অনেকদিনেও তেমনটি না ঘটায়, পুরো পরিবারটি টলে উঠলো। টেনে সমন্ধ করার মতো সবমাত্রা এখানেই
ভরাট হয়ে ওঠে। যোগাযোগের সেই আত্মীয়কে আবার ডেকে পাঠালেন। অবশ্য এর মধ্যে ঝালিয়ে দেখা
হয়ে গেছে ঝুলিয়ে রাখা আরো ক’জন পাত্রকে। কিন্তু ধোপে টিকতে টিকতেও অনেক ছিন্ন হয়ে গেছে
বাড়াবাড়ি আগ্রহের কারণেও। আর বেসিক কিছু শর্ত তো অবশ্যই জোরালো না হলে মেয়েকে আর সেখানে
পাঠানো যায় না। আর সমন্ধের জের... যে ধারায় মিশে যাবে নিজেদের রক্ত-বংশপরিচয়, তারা
সবদিকে সম্পন্ন না হলেও হাঘরে হলেও তো চলে না।
কলিংবেল বাজতেই মা রেবতী ছুটে যান। ভুলছুটও হয়েছে দু’বার। অতিথি ঘরে থাকতেই
বেল বাজতে না বাজতে ছুটে গিয়ে দেখেন পুরনো কাজের লোক দেখা করতে এসেছে। আরেকবার খবরের
কাগজের বিল। দেনা-পাওনার সামান্য ঝক্কি হলেও এমন সময় খুচরো সব আপদ-বিরক্তি বুঝতে দেন
না কাউকে। তৃতীয়বারের কলিংবেলে দরজা খুলেই আষাঢ়ের বৃষ্টির মতো ঢেলে পড়া কণ্ঠ তার-এত দেরি করলি? রাত এখন ক’টা? এই তো ওরা
এই মাত্র গেলো!’ রেবতীর পিছনে দাঁড়ানো ফয়জুল ইসলাম। এখনো চাকরিতে বহাল আছেন। তবে আর
মাত্র ক’দিন। ফয়জুল ইসলাম সংসারের সবকিছুতে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা থাকলেও ভাবখানা ঝুলিয়ে
রাখেন যেন তিনি কিছুতেই নেই। সব রেবতীর ভাগ্যেচক্রে আকাশ থেকে নেমে এসেছে। কিন্তু আজ
তার মুখেও মানচিত্রের মতো ভূমিকা ফুটে আছে গূঢ় কোনো বিষয়ে। এতেই খানিকটা ভড়কে যায় রাকিব।
যে সংকট মা তৈরি করতে পারেন না। মাকে সবাই ওরা মানে অবশ্য। তবে হেলায় ফেলায়। মাতৃভূমির
মতো জর্জরিত অত্যাচার।
-ওরা মানে? কারা এসেছিলো? রাকিব বিস্ময়ে ভেঙে ভেঙে প্রশ্ন করে মার চোখে।
-পাত্রীপক্ষ! রম্নবিনার বাবা নিজেই এসেছিলেন তার ভাইকে নিয়ে! ফয়জুল ইসলামের
উত্তর। বাবার এতদিনের নির্লিপ্তভাবটা এই প্রথম বর্ণিল হয়ে ওঠে রাকিবের চোখে। এদিক সেদিক
বিচরণে ভার্সিটি আর কলেজ পড়-য়া শামীম, তুহিনার যেন হরিণ ছুটছে মনে। অঘোষিতভাবে বিষয়টি
কেমন তারা মেনে চলছে, বড় ভাইয়ের বিষয়ে এসব কথাবার্তার মধ্যে তার সামনে যেন থাকতে নেই।
রাকিব নিজেকে এই প্রথম মারাত্মক সাবালক মনে করে। তিন ভাইবোনের দলটি ভেঙে সে এইমাত্র
বড়দের সারিতে উঠে গেছে যেন-বা।
ফয়জুল ইসলাম ক’দিনে টের পেলেন, চমক ভেঙে অনেকেই এবার ছেলের বিয়ের জন্য তার
কাছে প্রস্তাব পাঠাতে শু্রু করেছে। আত্মীয়স্বজনেরা পর্যন্ত! যেন মৌচাকে ঢিল দিয়েছেন
রম্নবিনার বাবা। অফিসে রাকিবেরও একই দশা। মৌমাছি উড়তে শিখলে শুধু সরিষার হলুদেই বিমোহিত
হয় না। গুঞ্জিকায়ও ধায়। শেষের দিকে নিজের চোখও ছানাবড়া হয়েছিলো সবাইকে দেখে। ফড়িং সাধে
কলেজ ইউনিভার্সিটিতে নিজের সৃষ্ট এক-আধটু পদ্যের বেপথু সত্মবক যে-কারো ওড়নার পুচ্ছ
জুড়তে চায়নি তা নয়। কিন্তু সবকিছুই কি চাইলেই যখন তখন মনের মাপে হয়? হয়তো কারো হয়। ‘হয়তো’
আবার কী? কতজনকে হতে দেখেছে না সে নিজের চোখে? কিন্তু তার হয়নি। হয়ে ওঠেনি। রম্নবিনাকেও
সে আরো অনেকের মতো নাকচের তালিকাতে ঢেলে সাজিয়ে রেখেছিলো। আবেগে মন মোমের মতো শিখা
হতে কি আছে ওর, মনে ওঁৎ পেতে খুঁজেছে ক’দিন। শিক্ষিত হলেই গতানুগতিক, আটপৌরে বলয় ভেঙে
ভিন্নমাত্রা পরবর্তী বংশধরের জন্য ক’জন মেয়ে এনে দিতে পারে? ও আসলে তেমনি কাউকে চেয়েছিলো।
যার মধ্যে একটি দুর্লভ তেজ থাকবে। সবাই আড়চোখে তাকাবে তার দিকে। সবার সে হবে ঈপ্সিতা।
তবে লোভে নয় অন্বেষণে। অথচ স্বভাব ও আচরণে থাকবে সে সরল। ধারালো অথচ নিরীহ অভিব্যক্তির
একটি ছোবল তার মধ্যে লুকানো থাকবে সবখানে নিজেকে রক্ষার।
না নিজের সম্পর্কে কোনো আহামরি ধারণা রাকিবের নেই। তবে যেটুকু আছে সেটুকু
যেন কেউ খাটো করে দেখাতে না পারে। ভরা সংসারটির প্রাণে কেউ যেন চিড় না আঁকে। সে অবকাশ
কারোই প্রশ্রয় দেবে না রাকিব। সংসারের সে বড় ছেলে। বছর তিনেক হলো চাকরির বয়স। একটি
রাষ্ট্রয়াত্ত সংস্থার প্রবেশনারি অফিসার। বেতন ভালো। তবে আড্ডার খরচ যোগান দিতে মার
হাতে মাস পয়লা যা দেয়, তার থেকে বেশ কিছুটা প্রতিদিন একটু একটু ফিরিয়ে নেয়। আর মা তা
ওভাবে পারেনও বাবার জোরে।
বাগানের যে ঝড় তছনছ করে দিতে চায় ফুলের প্রাণ, রাকিব তা আরো বেগে রুখে ধরে। দু’কূল সামলানোর চেষ্টায় সে মরিয়া। মাকে বলা যাবে না, বাবাকেও নয়। তুহিনা, শামীম
কাউকে নয়! অতো সহজে স্ত্রী’কে ছোট করা যাবে না। স্ত্রী’কে সম্মান করতে, ভালোবেসে দেবীর
মতো আরতি জানাতে কুণ্ঠা পুষে রাখবে মনে, তেমন প্রবঞ্চক তো রাকিব নয়! বাবা একদিন বলেছিলেন,
মানুষ সব গুণ নিয়ে জন্মায় না। প্রয়োজনে তাকে অর্জন করতে হয়। অন্যকে শেখাতেও হয়।
রম্নবিনা বিনা ভাড়ায় বাবার বাড়ির কোনো একটি ফ্ল্যাটে ওঠার বায়না ধরে যখন
ব্যর্থ, তখন চাকরির প্রচেষ্টায় মত্ত হয়ে উঠলো। এটাই বরং ভালো লাগে রাকিবের। এমনটিই
তো সে চেয়েছিলো। একটি সৎ, উদারচেতা পরিশ্রমী মেয়ে। যার মেধার চাকচিক্যের কাছে সোনাদানা
বাহুল্য হয়ে যাবে। নীতির প্রশ্নে যাকে টলানো যাবে না। মা যেমন ওদের পাঠানো ট্রাকভর্তি
ফার্নিচার ফেরত পাঠিয়েছেন। বলে দিয়েছেন, আমার বৌমা’র কোনো কিছু কমতি দেখছি না, যা এসব
দিয়ে পুষিয়ে দিতে হবে।
রাকিব নিজেই সহযোগিতা করে রম্নবিনাকে বাড়তি লেখাপড়ায়। ইন্টাভিউয়ের দিন নিজে
আয়োজন করে যথাস্থানে পৌঁছে দিতে। কিন' ইতোমধ্যে ফাটল চুঁইয়ে ক্ষরণের দাগ স্পর্শ করে
ফেলে মা রেবতীর প্রাণ। বাবাও কি তেমন কিছু টের পেয়েছেন? রেবতী কখনো বলেননি অবশ্যই,
কাউকে বলেননি, বউয়ের মুখ সব সময়ই অস্বস্তিকর মেঘলা থাকে। তার দিকে তাকানোর দৃষ্টিতে
সম্ভ্রম থাকে না! বউটি কি চায় বুঝতে আর কারো বাকি থাকলেও রেবতীর থাকে না।
না, খানখান হয়ে গেলেও এমন সব কথা এক কান থেকে আরেক কানে পৌঁছে দেয়ার মানুষ
রেবতী নন। এটা এ পরিবার ছাপিয়েও আরো আরো সবার জানা। কিন্তু অস্বসিত্মর ছায়া ছিঁড়েখুঁড়ে
খাচ্ছে সবার মুখের আলো। শামীম, তুহিনা কেমন কোণঠাসা করে রেখেছে নিজেদের। এই অবাঞ্ছিত
আয়োজনের ম-প কি তিনি নিজে সাজিয়েছিলেন একনিষ্ঠ আগ্রহে! স্বামীকেও বিসত্মারিত ভাবতে
অবকাশ দেননি। রাকিবকেও বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাগে এনেছেন! ওদের অর্থবিত্তের দিকটি কেউ পাত্তাই
দেয়নি ওদের আগ্রহকে সম্মান দেখানো ছাড়া।
কী দেখে তবে ওরা এখানেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিলো? মধ্যবিত্তের লিপ্সা নিয়ে
সাপুড়ের মতো খেলতে? আঁধার চোখ তবে এ বাড়ির কোন ফাটলে গলেছিলো? সেই ফাটল খুঁজে রেবতী
তন্নতন্ন হয়ে যান।
রম্নবিনার বাবা মেয়ের আব্দারে নানান জায়গায় জোর তদ্বির করছেন। তাতে একেবারে
যে কিছু হয় না তা নয়। কিন' ঠিক যে ধরণের কাজ করতে চায় রম্নবিনা সেরকমটি হয়ে উঠছে না।
তবু বাবা কোথায় একগাদা টাকা ঘুষ দিয়ে রেখেছেন মেয়ের কথায়। সেখানে ওর হবেই। আর তারওপর
ভর করে স্বপ্নের সৌধটি সাজানো শুরম্ন করে দিয়েছে সে। প্রথম মাসের বেতন হাতে এলেই, নিজের
টাকার জোরটুকু জোড়া দিয়ে রাকিবকে বের করে নিয়ে যাবে। বোঝাবে যুক্তির সব শর্তে। দু’জনের
মিলানো সঙ্গতি হিসেব করে সেরকম বাসাও নেয়ার পরিকল্পনা আঁটে। কিন্তু সম্পূর্ণ টাকা দিয়ে
এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আনতে হবে। ইন্টারভিউ যেমনই হোক চাকরি রম্নবিনার হবেই। সরকারি
কাজের কন্ট্রাক্টর বাবাই দিয়েছেন টাকাটা। রাকিবের টাকা না হোক, তবু ভজকট এ প্রসত্মাব
সে শুনলে ক্ষেপে আগুন হয়ে যাবে। আর তাতে পুরোপুরি ভস্ম হবে আসত্ম রম্নবিনা। জীবনে আর
মুখ তুলে কথা বলার সুযোগ থাকবে না। মুখ রাখার জায়গাই সে দেবে না এ বাড়িতে।
এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আনতে যাওয়ার ক’দিন আগে থেকে লোকটি খোঁজখবর নেয়া বন্ধ
করেছে, চাকরিটি যে পাইয়ে দিচ্ছে। একথোক টাকা হাতিয়ে নিয়ে গেছে। ঝুলিয়ে রেখেছে আর অল্পকিছু
চেয়ে। এবাড়ির সবার অগোচরে রম্নবিনার নির্দিষ্ট দিনটি এসে গেলো। সে ভেবেছিলো আজ বাবার
বাড়ি ধানমন্ডি গিয়ে কাউকে সঙ্গে নিয়ে যাবে, যেখানে ঝুলছে তার স্বপ্নের চাবি। রম্নবিনার
তটস্ত ভাবে রাকিব উদ্বিগ্ন। কিন্তু প্রচুর ঝামেলা থাকায় নিজেকে দ্রুত অফিসের জন্য তৈরি
করতে করতে বলতে লাগলো, আজ আমার সময় নেই। কোথায় যাবে বলেছিলে, মা’কে সঙ্গে নিয়ে যেয়ো।
একা বেরিও না।
বজ্রদপি শব্দগুলো প্রতিহত করে, সে শক্তি এমনিতে কেন যেন ক্ষীণ হয়ে আসছিলো,
সময় যত ঘনিয়ে আসছিলো রম্নবিনার। রেবতী আজো
সেই প্রথম দিনের মতো। যেদিন তিনি বুঝতে শিখেছিলেন, হাল ছেড়ে দিলেই প্রতিপক্ষ ঘায়েল
হয়ে যায়। তাকে পরাসত্ম করতে বড় অস্ত্রের অপচয় প্রয়োজন হয় না। আর কাকে কীভাবে হার মানাতে
হয় সময়-ই তাকে তা রপ্ত করতে শিখিয়েছে। গতিতে আজো তিনি সন্তানদের চেয়ে এগিয়ে। যারা
তারই সৃষ্টি। তাদের কাছে হারতে পারাই হবে তার শ্রেষ্ঠ অর্জন। তেমন দিনই তার কাম্য।
স্বভাবে, গড়নে আজো সমান ঋজু রেবতী মনেপ্রাণে আরো শক্তি প্রার্থনা করে নিজের জন্য। জীবনে
যে তার আর এমন দুর্দিন আসেনি! এতবড় ধ্বংসের থাবা থেকে তিনি যেন সবাইকে রক্ষা করতে পারেন।
একটি শিশুর মুখে এত মায়া, তাই যাকে দেখে প্রথম বুঝেছিলেন, আজ সেই তাকে এমন ঘোলাজলে
পাক খেতে দেখে নিজে সি'র থাকেন কীভাবে!
শেষবারও ট্যাক্সি থামলো যেখানে সেটাও ভুল ঠিকানা। কোথাও তার ঠিকানা খুঁজে
পাওয়া গেল না, যেখানে রম্নবিনার চাকরির এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটি নিয়ে অপেক্ষা করছে
পরিমার্জিত তুখোড় সেই ভদ্রলোকটি। যার হাতে নির্দ্বিধায় গুঁজে দেয়া যায় হাজার ত্রিশেক
টাকা।
বিন্দু বিন্দু ঘামে করুণ হয়ে উঠছে রম্নবিনার কপাল। দ্রুত গতিতে ছুটেও
ট্যাক্সি আটকে যাচ্ছে। পথের ভেতরই স্থিত পর্বতের মতো দুঃসহ ঠেকে রেবতীর নিজেকে। সিটের
অপরপ্রান্তে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন, খোলা সুতোর গুটি নিজে টেনে রাখার মতো। এতো ক’ঘণ্টা
শাশুড়ি বউ কেউ কারো সঙ্গে কথা বলেনি। দু’জনেই নিজে নিজে অস্বসিত্মর শব্দ করা ছাড়া।
ঘর থেকে বেরম্নতেও তারা কম গুমোট ছিলো না। তৈরি হতে হতে রম্নবিনা লক্ষ্যহীনভাবে বলেছিলো
আমতা করে, তুহিনকে নিয়ে যাই...।’ রেবতী তাতেই শিকার ধরার মতো উত্তেজনায় কেঁপে উঠে বলেছিলেন,
আজকে আমাকে তোমার সঙ্গে যেতেই হবে বৌমা!
ধোঁয়া গলিয়ে ট্যাক্সিখানা হোঁচট খেয়ে এগাতেই রেবতীর ভাবনা পাল্টে যায়-সবকিছু
দু’হাতে ঠেকিয়ে রাখার সাধ্য কেন অর্জন করতে পারিনি! পারলাম না মেয়েটিকে নিপাট সুখের
ভাঁজে জীবনটাকে দেখাতে। সব কিছু এত অসময়ে অসংলগ্ন হয়ে উঠলো... জীবনে মাহেন্দ্রক্ষণ
এসে কখন ছায়ার মতো ডেকে চলে যাবে টেরই পাবে না...। রম্নবিনা চুপসে আছে। ঘোরকালিতে লেপটে
আছে তারও মুখ। কিন্তু রেবতীর দৃষ্টি আরো দূরে কোথাও।
সে এমুহূর্তে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ও। বহু আমানত রক্ষার হাতখানা এবার অবেচতনে
বাড়িয়ে দেন। ভাবেন, এত অন্য কেউ নয়, নিজের সনত্মানের চেয়ে এর সঙ্গে পার্থক্য কিছুই
নেই। কাছে টেনে আনেন বউটিকে। কাঁধের ওপর ওর মাথাটি ধরে রেখে বলে যান, ‘রম্নবিনা, তোমার
কত টাকার প্রয়োজন? হানিমুনে যাবে নেপাল অথবা সিংগাপুর? বলো আমার কাছে অনেক টাকা আছে!
তোমার শ্বশুরের পেনশনের পুরো টাকা আমার নামে জমা আছে তোমাদের জন্য...। এটুকু বলতে বলতে
সহসা নিজের কাছে নিজের কণ্ঠ অপরিচিত ঠেকে থেমে যান রেবতীর। মনে মনে ভাবেন, স্বপ্নের
চাবি কোন হাটে বিক্রি হয় জানা থাকলে আজই এনে দিতাম একে! ছেলেটি যে বেতন পায় তাতে একটি
ভালো বাসা, সংসার খরচ...। না, ভাঙন ঠেকানোর লোভে পেয়ে বসেছে আমাকে। কেন থাকবে এত লোভ?
এসব নিয়ে আর ভাববো না! রেবতী আবার চুপসে যান।
বিকেলনাগাদ বাসায় ফিরলে দু’জনেরই উদভ্রানত্মভাব সবাইকে বিচলিত করলো। কিন্তু রেবতীর বলার মতো কিছু ছিলো না, যাতে সবার আনন্দ বিকশিত হতে পারে। রেবতী তো কারো কোন প্রহর বিষণ্ন করতে পারেন না অস্তগামী সূর্যের রাগ ঢেলে স্বচ্ছ জলের মতো! আঁধার ঝাঁপানো ঝুলবারান্দার ক্যাকটাসফোটা টবের পাশে
ঝুঁকে বসে নীলকণ্ঠ তিনি ঘনিয়ে ওঠা বুদ্বুদ সংহার করে চলেছেন আপনপ্রাণে। কতক্ষণে পারবেন...,
ঝিম ধরে বসে থেকে সন্ধ্যা পার করলেন। রাকিব এলো আরো পরে। প্রায়ই দেরি করে ফেরে ছেলেটি।
বিয়ের আগে আরো করতো। তার চাকরির ধরনই নাকি এমন। রম্নবিনা কাত হয়ে শুয়ে আছে ঘুমের ভানে।
ছেলের হাতে তুলে দিতে নিজের হাতের কাপে চা টলে ওঠে রেবতীর। এরি ভেতর নিজেকে টেনেটুনে
বরাবরের চেয়ে আরো রয়েসয়ে বলতে থাকেন, খোকা তুই বউকে নিয়ে আলাদা বাসায় চলে যা। এটা আমিই
চাইছি! এতে বাসায় কারো অমত হবে না...।’
কথা শেষ হওয়ার আগেই চলে যেতে যেতে
আবার ঘুরে দাঁড়ান রেবতী। কিন্তু একটু থমকেই বেরিয়ে যান। দৃষ্টির মধ্যে চাবুকের মতো লকলক
করে ওঠা বিদ্যুৎপ্রবাহ নিয়েই ফিরে যান তিনি। রাকিবের সমস্ত সত্তা তাতে বিকীর্ণ হয়ে
ওঠে। অসংলগ্ন সে ফ্যাকাসে মুখখানায় রক্ত ধরে রাখতেই চায়ের কাপে কম্পিত চুমুক তোলে।
তারপর যেন নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলতে থাকে, আমার মায়ের আসল নাম রেবা!
আমার বাবা শুধু ডাকেন রেবতী। একজন মানুষ ‘রেবা’ আর ‘রেবতী’ নিজের দুটি নাম
সমানভাবে প্রতিষ্ঠিত করে রাখতে পেরেছেন যে বলয়ের ভিতর, সেখানে ঢুকে এতদিন তাকে তোমার
চেনা উচিত ছিলো! অবশ্য এই শঙ্কা আমার বুকে বাজিয়েই তুমি এই ঘরে এসেছো! এবং আমার মায়ের
আগ্রহেই তা হতে পেরেছে। তোমরা সবাই নিবিষ্ট হয়ে তার কৃপা ভিক্ষে চেয়েছিলে, অথচ, তোমরা
তাকে একটুও বুঝতে পারোনি।
ঋজুতাই যার সবকিছু জয়ের অনায়াস শক্তি, অপশক্তি ছাড়া কেউ তার সঙ্গে লড়তে
যায় না। কিছুই বাঁধতে চান না আমার মা! কাউকেই বাঁধতে চান না, তাই থেকে যেতে হয় রেবা
নামের নদীটির কূলে। আর ‘রেবতী?’ সাতাশটি নক্ষত্রকে ওই একটি নামে ডাকা হয়। তুমি তার
একটির মতো ওয়ে ওঠো অন্তত! যিনি পরের সন্তানকে কোনোদিন জানতে দেননি যে, তিনি তার মা
নন। আর সে কথা যেদিন আমি প্রথম জেনেছিলাম, সেদিনও আর কোনো মুখ খুঁজে নিজেকে দেউলিয়া
সাজিয়ে দেখার সাহস আমার হয়নি। রম্নবিনা, এতদিন পর ডেকে এনে সে সাধ তুমি আমার বুকে না-ই
বা জাগালে!
অসম্ভব সুন্দর। যেন আমারই জীবনকথা।
উত্তরমুছুন