Header Ads

1 / 5
1 / 5
1 / 5
1 / 5
1 / 5

যৌথ স্মৃতিকথা — আব্দুল কাফি

আব্দুল কাফি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক। প্রবন্ধ ও অনুবাদ তাঁর সাহিত্যচর্চার অন্যতম অঙ্গ।   


অভিনেতার জার্নাল
বিতান চক্রবর্তী
পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ জুন, ২০১৭
প্রকাশকশাম্ভবী
মূল্য১২৫ টাকা

সেই কবে ম্যাকবেথ নাটকে ব্যবহার হয়েছিল এই মেটাফর, জীবন এক চলমান ছায়া যেন, এক ক্ষীণ অভিনেতা, যে তার সময়কাল মৃদু ও অনুচ্চার প্রলাপেই পার করে দেয়, মঞ্চের উপর থেকে অপসৃত হয় তার ছায়া তারপর, হারিয়ে হারিয়ে যায় তার কথামালা। জীবনকে অভিনেতার সঙ্গে তুল্য করে দেখবার এই অভ্যেস সেই থেকে ঢুকে গেছে নানা ভাষা ও কালের লোকসংস্কারে। বিতান যখন লেখেন তাঁর ছোট গদ্যের বইপাঁচটি মাত্র স্মিত রচনার এক নম্র সংকলনঅভিনেতার জার্নাল তখন কি কেবল তাঁর অভিনয়-জীবনেরই টুকরো মুহূর্তগুলি গেঁথে তুলতে চান তিনি? কেবল কি কখন কখন তাঁর কী কী মনে এসেছিল, তারই এক খতিয়ান মলাটবন্দী করেন বিতান? না, তা নয়। বিতান বরং ধীরে ধীরে এক গাঢ় ও বেদনাশ্রয়ী জীবনের আদল ফুটিয়ে তোলেনপৃথিবীর অন্য অনেক বড়ো লেখকের মতো হয়ত খানিক অগোচরেই থাকে তাঁর এই প্রক্রিয়া। একটি সংঘবদ্ধ নাট্যগোষ্ঠীর নিয়মিত অভিনেতা হিসেবে টুকরো কয়েকদিনের কথা, সেই দিনগুলিকে স্পর্শ করে, ছুঁয়ে বসে থাকা, নাট্যাভিনয়ের দু-চারটে মৌলিক সমস্যাকে সামনে রেখে বিতান অনায়াসে চলে যান বৃহৎ গহনজীবনের নানা পরিপ্রশ্নে। এবং সেসব তখন আর নাট্যাচিন্তাতুর কোনো অভিনেতার চটজলদি, জবাবপ্রত্যাশী প্রশ্নমালা থাকে না, সেসব জিজ্ঞাসা তখন হয়ে উঠতে থাকে ক্রমশ দীর্ঘ, প্রলম্বিত ছায়াময়, প্রায়শই যারা উত্তরের চাইতে অনেক বড়ো কোনো পরিসর দাবি করে বসে। সেসব সংকট তখন কোনো এক মফস্‌সলি যুবকের তাৎক্ষণিকতাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় বহুদূর, কখনো রবীন্দ্রনাথে, কখনও শম্ভু মিত্র  বা উৎপল দত্তে, কখনো আবার কোনো ব্যক্তিকে নয়, সার্বিক দার্শনিক সমস্যার প্রান্তদেশ ছুঁয়ে ফেলে তারা।

অভিনয় কি মানুষের গভীর কোনো প্রয়োজন, কোনো গূঢ় প্রশ্নের উত্তর এনে দিতে পারে? থিয়েটার পারে কি নানাভাবে নিঃস্ব হয়ে আসা এক ব্যক্তির সামনে এসে দাঁড়িয়ে গড়ে দিতে কোনো সদুত্তর? বিতান জানতে চেয়েছেন তাঁর একটি লেখায়, চায়ের দোকানে কিংবা অন্য নানা দিনাতিপাতের অভ্যেসে জীবনের সত্যিকার মানে টের পাওয়া দুষ্কর, কেন আছি, কেন বেঁচে আছি, সেই প্রশ্ন যদি কভু ধ্বস্ত করে তোলে মানবহৃদয়, যদি কোনো চোরাটানে বিপন্ন করে দেয় আচমকা সব স্থির হিসাব-কিতাব, সে সময় থিয়েটার এবং তার সহযোগী বন্ধুরা এসে, রেখে যেতে পারে কোনো পালটা সম্ভাবনা, জীবনের কোনো এক বিকল্প মানে। যোগে, সংযোগে অন্য কোনো ব্যক্তি হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটিতে পা রেখে, অন্য চরিত্রের মাঝখানে একটি ভাসমান পরিসরে নিজের আমির-বোধটিকে মিশিয়ে-মিলিয়ে দিয়ে, নিজেকে হারাতে হারাতে, পেয়ে যাওয়া গাঢ় আহ্লাদ, তাকেই বলেন তিনি থিয়েটারের আনন্দ। সূচিপত্র অনুযায়ী মূল লেখাটির নাম, মঞ্চ থেকে মাটিতে, কিন্তু সেই লেখায় পৌঁছে দেখা যাবে, পিছুপিছু বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র লেখার সংগত্‌ আছে সেখানে। কিংবা বলা যেতে পারে মঞ্চ থেকে মাটিতে অবতরণের কয়েকটি ক্ষুদ্র সোপান যেন রয়েছে সাজানো। ধারাবাহিকভাবে এসে যাবে পরপর, যেন সুতোর গিঁট, জীবন এসে মেশে, জীবন, থিয়েটার , কেন্দ্র ও সংগঠন, জীবন, জীবিকা, থিয়েটার। একটি আধারে ছোটো ছোটো আরও তিন প্রশ্ন। লাগোয়া। কেন থিয়েটার করবে কেউ, এই প্রশ্ন নিয়ে চলতে শুরু করে ধীরে ধীরে লেখা এসে দাঁড়ায় কেন্দুলির মেলায় একটি বাউল গানের আসরে। একটি নিপুণ অ্যানেক্‌ডোটে বিতান তুলে আনেন শিল্পীর বেঁচে থাকার সংকট এবং আনন্দের প্রশ্নটিকেমুখোমুখিই প্রায় দাঁড় করিয়ে দেন তাদের। আনন্দবাদী শিল্পী কী করে বেঁচে থাকবে তবে, যদি তার উপার্জনে থাকে ভয়াবহ অনিশ্চয়তা? কীভাবে সে বাঁধবে গান, কীভাবে আসবে রিহার্সালে, নিয়মিত? শম্ভু মিত্র, অজিতেশ আর উৎপলকে ছুঁয়ে এ প্রশ্ন নিয়ে বিতান হাজির হন আখড়ায় এক নাম না জানা বৈষ্ণবীর কাছে। সারারাত অকাতরে গান শুনিয়ে ভোরবেলা যখন সে অর্থ প্রার্থনা করে শ্রোতাদের কাছে, এবং যথারীতি শ্রোতারা এতক্ষণ গান শুনে অবশেষে খানিক নির্বেদ প্রদর্শনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সহসা এবং তারই ফলে হয়ত শিল্পীর আবেদনে তেমন গা করেন না, তখন সেই অখ্যাত শিল্পী নিজেই বলে ওঠেন, সহাস্য, যে, গান তিনি গাইবেন ফের, এমনকি, তার পরের দিনও, সেখানে খামতি নেই, কিন্তু এই গানের মাধ্যমেই তিনি বেঁচে থাকার রসদ খোঁজেন, অন্য কিছুই আর করেন না। এবং এভাবেই ভিক্ষে করেন তিনি, এভাবেই জীবঙ্কে তিনি ধরে আছেন। শিল্পে যেন মতি থাকে তাঁর এটুকুই তাঁর প্রার্থনা। ফলে শ্রোতাদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ তাঁর ক্ষত্রে জরুরি খুব, বেঁচে থাকার জন্য, আবার গান গাওয়ার জন্য। জীবিকা আর আহ্লাদের এই পরস্পরের মুখোমুখি প্রায় লড়াকু অবস্থানে এসে দাঁড়ানো দেখতে কষ্ট হয় এ বই-এর কথকলেখক বিতানের, ইন্ডাস্ত্রি হয়ে উঠতেই হবে থিয়েটারকে’—এহেন ঘোষণায় কখনো কখনো তাঁর বেদনা জেগেছে ঠিকইঅথচ শিল্পীর গ্রাসাচ্ছাদনের সংকট মিটবে কীভাবে তারও কোনো স্পষ্ট সদুত্তর নেই তাঁর কাছেআরও আরও আত্মত্যাগ, আরও বেশি করে নিবিড় স্বার্থহীনতায় নিজেকে মুড়ে ফেলা, আরও-বেশি-উপার্জন ও আরও-বেশি-সঞ্চয়ের প্ররোচনা ত্যাগ করবার কথা তিনি বলেন ঠিকই, কিন্তু খুব কি জোরালো ঠেকে তাঁর সে ঘোষণা? বিতান জানেন, কেনাবেচার এক ভয়াবহ ভাষা ক্রমশ ঢেকে ফেলছে শিল্পকে, থিয়েটারকে। তিনি শুধু শিল্পীর উদ্দেশ্যে প্রাণপণে বলে যেতে পারেন সঞ্চয় সন্ন্যাসীর পক্ষে পাপ, শিল্পীর পক্ষেও। কারণ এক হিসেবে শিল্প সন্ন্যাস।

কিংবা ধরা যাক অর্ধেক জন্ম নামের চতুর্থ রচনাটির কথা। কথকের অস্থিরতা এবং জীবনের নানা গরমিল ফুটে বেরিয়েছে লেখাটির শরীরে। ভারি এলোমেলো, একের পর এক আপাত অলগ্ন অ্যানেক্‌ডোট, কখনো স্কুলের মাস্টারমশাই, কখনো কবি শঙ্খ ঘোষের বাড়ির বৈঠক-খানায় ছুটে যাওয়ার গল্প, আবার পরক্ষণেই টালিগঞ্জের সুপ্রীতিদার সংলাপ। এসব অশান্ত ঘটনাবৃত্ত পার করে বিতান আসলে ধরে ফেলতে চান শিল্প আর জীবনের সম্পর্ক নিয়ে বহু পুরাতন তর্কের সীমানা। নিশ্চিত করে বুঝতে চান সে সম্পর্ক, এবং ভারি কাতর শোনায় তাঁর এই জিজ্ঞাসানা, কোন শিল্পতাত্ত্বিকের দার্শনিক সন্দর্ভ রচনার লক্ষ্য তো নেই তাঁর, তাঁর কাছে এ প্রশ্নের উত্তর জানা ঢের বেশি জরুরি, যেন  এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে কিনা তারই উপর নির্ভর করে আছে তাঁর বেঁচে থাকার অর্থ, হয়ত, এই সিদ্ধান্তের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে কেমন হবে তাঁর শিল্পের বোধ, শিল্পের প্রতি কী চোখে তিনি তাকাবেন, কী তিনি চাইবেন শিল্পের দিকে হাত বাড়িয়ে, নাটক গল্প কবিতা কী তাঁকে দিতে পারে আদৌ, কী রয়েছে তাদের আড়ালেসেসব গুরুতর প্রশ্নের উত্তর। এবং বিতানের কথনপ্রণালী দেখে মনে করতে ইচ্ছে হয় এসব প্রশ্নের উত্তর তাঁর কাছে কেবল বিমূর্ত শব্দাবলি নয়, যেন এসব উত্তরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে তাঁর সমগ্র জীবন। তাঁর সময়।

সমকালীন গল্পকার এবং ঔপন্যাসিকদের প্রসঙ্গও উঠে আসে তাঁর এই প্রায়-স্বগতকথন-এ। বিনোদ ঘোষাল কিংবা স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর গল্প-উপন্যাসকে তিনি প্রশ্ন করে বসেন অপরূপ সারল্যে। বিনোদ ঘোষালের গল্পের চরিত্র নন তিনি ভেবে, প্রায় হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন বিতান, তিনি সে গল্পের বাইরের লোক, সে গল্পের দুর্বিষহ ফাঁদের বাইরে তাঁর বাসএই কথা ভেবে তাঁর স্বস্তি বোধ হয়। কিংবা তিনি প্রশ্ন করে বসেন স্মরণজিৎ চক্রবর্তীকে, কেন তাঁর রচনায় আরো সরাসরি, আরো তীক্ষ্ণ, আরো বেমক্কা সিঙ্গুরের গাড়ি-কারখানার বাস্তব প্রকট হয়ে ওঠে না? কেন লেখক রচে নেন খানিক আড়াল, একখানি প্রচ্ছদে ঢেকে রাখেন তাঁর লোকলস্কর, চরিত্রগুলিকে? আসলে বিতান গল্পে নাটকে আখ্যানে তাঁর সময়ের আরো নিবিড়, আরো পাকাপোক্ত ছাঁচ প্রত্যাশা করেন, জীবনের গাঢ় সমাচার আর সাহিত্যের বয়ানে কোনো ফাঁক বা অন্তর তাঁর বেমানান ঠেকে। অথচ এও তিনি জানেন, হয়ত এই আর্ত জিজ্ঞাসা অনেকের কাছে মনে হবে উর্হতহীন, হয়ত পাঠক এ লেখা পরে বিরক্ত হবেন ভেবে তিনি, তাই, এসব প্রশ্ন শুধু গচ্ছিত রেখে দেন নিজের কাছেই। লেখাটির শেষ অনুচ্ছেদে ঈষৎ বিষণ্ণতা আসে তাঁর স্বরে। পাঠকের নিরাপত্তা ও স্থিতি তিনি ফিরিয়ে দেন অকাতরে। লেখেন, আপনি বিরক্ত হবেন না, প্লিজ। আপনার দক্ষিণের জানালাটা খুলে রাখুন। এই দেখুন, সন্ধের পাখিরা উড়ে যায়, আলতো হাওয়া আপনার প্রেমিকার নামে চুমু খেয়ে গেল। অন্ধকার হয়ে আসছে? সিএফএল-এর সুইচটা আপনার ডান হাতে। যে পাঠককে সম্বোধন করেন তিনি এই খানে, তার স্বভাব ও চরিত্র খুব সহজেই অনুমেয়। অনুমান করা যায় তাঁর ঠিকানা-সুলুক। আমরাও জানি, বিতানের প্রশ্ন এই পাঠকের দরজায় বারবার ঠোক্কর খেয়ে ফিরে আসবে। তাই-ই ঘটেছে আগে, অতীতেও। আরও বহুদিন বোধ হয় তাই-ই ঘটবে। সিএফএল ল্যাম্পের আলোতেই যাদের সব আঁধার ঘুচে যায়, তাঁরা বিতানের এই আর্তনাদ কীভাবে শুনতে পাবেন?

উলটো ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে অভিনেতার জার্নাল নামাঙ্কিত লেখাটিতে। একজন সত্যি-অভিনেতা তার অভিনয় জীবনের এককেটি দিন তুলে আনছে এখানে, না দিন নয়, বলা ভালো একেকটি মুহূর্ত, এনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে পুনর্বিচারের জন্য। অভিনেতা কি আদৌ পারেন তাঁর বিপরীত মনোভাবের কোন চরিত্রের মধ্যে অনায়াসে ঢুকে পড়তে, সেই ব্যক্তিরটির নানা সূক্ষ্ম অভিব্যক্তি, সেই ব্যক্তির নানা স্বাভাবিক মনে-হওয়া-কে তিনি বিশ্বস্তভাবে প্রকাশ করতে পারবেন কি? নাকি অভিনয়ের মুহূর্তে তাঁর নিজের মনোভাব চেপে বসতে চাইবে চরিত্রের উপর? অভিনয় করতে করতে তিনি সেই চরিত্রের প্রতি তাঁর বাস্তব বিরাগ ও অস্বস্তিসমূহ অপ্রকাশ্য রাখতে পারেন না? ঘটে কি এমন? এই ছিল তাঁর শুরুর প্রশ্নকিন্তু সে প্রশ্নের কোনো সন্তোষজনক নিশ্চিত উত্তরে পৌঁছনোর আগেই বিতান চলে যান পরের একটি দিনের জার্নালে। বোঝা যায় কোনো উৎসাহ নেই তাঁর নিশ্চিতিতে। কোন গাইডবুক তিনি প্রস্তুত করতে আসেননি, তিনি বরং অনেক বেশি আগ্রহী প্রশ্নগুলিকে, তাঁর অসহায়তাগুলিকে, নিজের বিষণ্ণ অমসৃণ চলাচলকে ধরে রাখতে। এই লেখাগুলির তাই কোনো আলাদা নাম নেই, তারা আসে কেবল দিনের, তারিখের চিহ্ন বইতে বইতে, তারা এসে কোনো উত্তর যোগায় না, কেবল প্রশ্নটুকু, অস্বস্তিটুকু, আর কখনো কখনো খুব অস্ফুট দু-একটা সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে চলে যায়। ক্ষুধিত-পাষাণ চলচ্চিত্রে ভালো লাগেনি সৌমিত্রকে, তপন সিংহের গল্প হলেও সত্যি বরং অনেক প্রাঞ্জল এবং স্মরণীয়; আপনজন ছবিতে চিন্ময় রায় নিজেই কি খানিক বিস্মিত হয়ে যাননি নিজের নিখুঁত কাজ দেখে? এমন নানা অভিমত লিখে রাখা হয়, সন তারিখ সাজিয়ে। শুধু অভিনয় করার অভিজ্ঞতা নিয়েই নয়, অন্য প্রসঙ্গও এসেছে বৈকি।

পার্কসার্কাসের চত্বরটাকে নরক মনে হয়েছে কথকের। একটি লেখায় তিনি ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত ভঙ্গিতে লিখেছেন সে কথা। লিখেছেন, যীশুর উদাসীন নম্রতার নীচে তাঁর শিশুরা গড়াগড়ি খাচ্ছেদেখেছেন তিনি। উদাসীন নম্রতা এবং তাঁর শিশুরা’—এই দুই শব্দবন্ধে কি শ্লেষ ছিল, বিতান? এ বইতে অন্তত শ্লেষ কম ব্যবহার করেন তিনি, আসে মাঝে মাঝে ঠিকই, কিন্তু ব্যথাকে তা ছাপিয়ে উঠতে পারে না কিছুতেই। ফলে তার কটু বা ধারালো ঝাঁঝ থাকে না তেমন। একটুকরো মন-খারাপ নিয়ে সেই নরক পার হতে হতে, আঁধারের কিনারা ঘেঁষে সেই দেবশিশুদের আহ্লাদে লুটোপুটি খাওয়া দেখতে দেখতে, রিহার্সালে পৌছে যান তিনিতাঁর নিজেরই কথায় ওই সময়টা আমার  সপ্তাহের সেরা সময়। দেরি হয়ে যায় প্রায়শ, ওই নরকের কাছাকাছি এসে কি তাঁর গতি কমে যায় রোজ? ওই নরকের অভ্যন্তরে বিচরণকারী দেবশিশুদের কোনো কোনোদিন তিনি রিহার্সাল অবদি টেনে নিয়ে যেতে চান। যীশুর বলয় থেকে তাদের বের করে নিয়ে যেতে চান এমন এক স্থানে যেখানে মানুষের সহৃদয়তার দিকে যাত্রার প্রস্তুতি চলে সারাক্ষণ। আরও আরও সহৃদয়, আরও মানুষের কাছাকাছি, আরও বেশি মানুষের অভ্যন্তরে হাত-পা ছড়িয়ে নিঃশ্বাস নিয়ে, গা-ঘেঁষে থাকার অভ্যেস, আরও আরও মানুষের জীবনের সঙ্গে ক্রমাগত জুড়ে যেতে থাকা, আরও মানুষের হৃদয়ের জোছ্‌না বা আঁধার-রজনী আবিষ্কারএই তো থিয়েটাররের কাজ। এই কাজে পার্কসার্কাস নামক নরকটি, যিশুর পদতল থেকে উঠে এসে সামিল হবে কবে? বিতান জানেন? বিতান কি সেকথা তাঁর পরের জার্নালে জানাবেন আমাদের?

কেন এমন একটি বই এখন লিখলেন বিতান? এমন কৃষকায়, মিতায়তন একটি বইয়ের আধারে কেন তিনি ধরে রাখতে চাইলেন গুটি পাঁচেক ছোটো লিখনসামগ্রী? এক হিসেবে এ সবই তাঁর আত্মপরিচয়, তাঁর হয়ে ওঠার খতিয়ান, ছড়ানো-ছেটানো এক প্রশ্নমালাযা তাঁকে পীড়িত করেছে, ব্যথিত করেছেযেমনটি তিনি লিখেছেন এ বইয়ের ভূমিকায়, নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ের কাহিনি নিয়েই এ বই। অন্য এক দিক থেকে আবার এই রচনাগুলির নানা ভাঁজে জমানো রয়েছে একটি প্রজন্মের স্মৃতিবিবরণঃ মিছিল-পাল্‌টা মিছিল, ভঙ্গুর গাড়ি কারখানা, সমকালীন গল্পকারদের হাতে নতুন ভাষাভঙ্গির আগমনবার্তা, সেকালে রচিত নাটকের রিহার্সালে ধীরে ধীরে কিংবা আচমকা একালের যাতনাচিহ্নের আবির্ভাব, প্রত্যাশা, হতাশা আর জীবনের প্রচুর ভাঁড়ারসব উঠে এসেছে এসব লেখায়। বিতান হয়ত অজ্ঞাতসারে এক যৌথ স্মৃতিচিত্রের জন্ম দিয়েছেন। দু-হাজার-সাত থেকে প্রায় এক দশকের ব্যবধানে ফিরে তাকিয়েছেন তিনি ও তাঁহারা। এটি ফলত, শেষতক শুধু বিতানের নয়, তাহাদের কথা, জীবন ও শিল্পের ছেদ পীড়িত করেছে যাদের, যারা দু-হাজার-দশ-এগারোর আশেপাশে হঠাৎ আবিষ্কার করেছে, অনিবার্যভাবে সকল মানুষ আসলে একেকটি মঞ্চাভিনেতা, এক গূঢ় ও জটিল চিত্রনাট্য সে লিখেই চলেছে ক্রমাগত। প্রশ্ন থেকে প্রশ্নে, তার অভিযাত্রা কোনোদিন ফুরোবার নয়। বিতানের এই মৃদু পুস্তিকা সেই অভিযাত্রার এক সার্থক খতিয়ান হয়ে রইল, এই আমাদের প্রাপ্তি। নিজের প্রথম বইতে তিনি আমাদের প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিলেন। যা তিনি দিয়েছেন তাকে ছাপিয়ে যা-তিনি-দিতে-পারেন তার ইঙ্গিত এখন মুখ্য হয়ে রইল।



ফেরারি প্রকাশঃ ১৩.১০.২০১৭

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.