শরণার্থী---------প্রিভিউ
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায়
ব্যক্ত নিষ্কাম কর্মের ধারণা বাস্তবে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবনের মুখোমুখি হওয়া মানুষের
কাছে এক প্রহেলিকা বয়ে আনে। আবার গীতার অনেক স্বীকৃত ব্যাখ্যাতেই সমস্যাসঙ্কুল
যাপন থেকে ‘মুক্তি’র পথ হিসেবে নিষ্কাম কর্মকে দেখা হয়েছে। সাদা চোখে কর্ম ও তার ফলের মধ্যে যে
সম্পর্ক, তাকে অস্বীকার করা যায় না; আবার কর্ম আর ফলের মধ্যে সম্পর্কটাও সব সময়
যুক্তি-নির্ভরতায় বাঁধা থাকে না। তাই গীতার কর্মের আর মুক্তি বা মোক্ষের ভাবনা বাস্তব
ক্ষেত্রে তো বটেই, দার্শনিক উপলব্ধির জায়গাতেও অনেকসময়েই সমস্যা সৃষ্টি করে থাকে।
বিশেষত নাস্তিকের কাছে, কামনাকে ঊর্ধ্বায়িত করার এই ধারণা কোনো স্পষ্ট বার্তা নিয়ে
আসতে পারে না। জড়বাদী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে গীতার কর্মযোগ ও মুক্তিকে ব্যাখ্যার
প্রচেষ্টা নতুন না হলেও বিতান চক্রবর্তীর লেখনী এই দার্শনিক সমস্যাটিকে
ব্যাঞ্জনাময় ভাষায় বিশ্লেষণী প্রকাশে সক্ষম হয়েছে।
‘শরণার্থী’ হল কিরীটী সেনগুপ্তের ‘রিফ্লেক্শনস অন স্যালভেশন’১ নামক গ্রন্থটির ছায়ানুসরণে রচিত এক
নব্য অনুভূতি জাগরণকারী গ্রন্থ। কিরীটী তাঁর বইতে গীতার কর্মযোগ ও মোক্ষের
ভাবনাগুলি আধুনিক বস্তুবাদী দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর রচনায় যেমন
চিকিৎসকসুলভ নৈর্ব্যক্তিক দূরত্ব যেমন আছে, তেমনই আছে ব্যাঙ্গের তীব্রতা। বিতান চক্রবর্তী
ডা. সেনগুপ্তের লেখাটির
অনুসরণ করলেও সরাসরি অনুবাদের মধ্যে যাননি। তিনি নিজের পারিপার্শ্বিক থেকে উদাহরণ
নিয়ে, বাঙালি জীবনকে স্বীকার করে কর্ম ও মোক্ষের মূল বৈশিষ্ট্য বোঝার চেষ্টা
করেছেন।
এই গ্রন্থের লেখক বিতান চক্রবর্তী অন্যত্র
তাঁর ‘হন্তারক’ গল্পে দুটি চরিত্রের
মধ্যে সংলাপ লিখেছেন এইভাবে -
“ - আপনি কি শুনেছেন, আমাদের এ অঞ্চলে কয়েকদিন ধরে কিছু লোক নিখোঁজ হয়েছেন?
-হ্যাঁ, তবে
শব্দটা ‘নিখোঁজ’ নয়, ‘খুন’ বোধহয়।
- না না,
নিখোঁজ। মানুষের মৃত্যুর পরের ডেস্টিনেশন কি কেউ জানে?
- না।
- তাই এরপর সব
নিখোঁজ।”২
গীতায় মানুষের
জীবনে কর্তব্য ও নীতিবোধের দ্বন্দ্বকে যে ভাবে দেখা হয়েছে, তার ব্যাখ্যা কেবল একটি
তো নয়। দ্বিতীয় অধ্যায়ের একটি শ্লোকে বলা হচ্ছে –
অব্যক্তাদীনি
ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত।
অব্যক্তনিধনান্যেব
তত্র কা পরিদেবনা।। ( ২। ২৮)
অর্থাৎ, সব
প্রাণীই জন্মের পূর্বে অপ্রকট ছিল এবং মৃত্যুর পরেও অপ্রকট হবে, কেবেল মধ্যভাগ
প্রকট বলে মনে হচ্ছে। সুতরাং এতে শোক করার কী আছে? এই শ্লোকের অর্থ যদি অজ্ঞাবাদী
(Agnostic) ভাবনা
থেকে করা হয়, তাহলে কি খুব অন্যায় হবে? জীবন থেকে সরে আসা কী মুক্তি? সংসার থেকে
সরে যাওয়াই কী সন্ন্যাস? যাঁরা নির্বিকারভাবে সংসারের সকল দায়িত্ব পালন করেন, তিনি
কি নিজের অহং থেকে বিযুক্ত হয়ে সংসারের বব্ধনের মধ্যেই সন্ন্যাসের স্বাদ পান না? এই সব জটিল প্রশ্নের আশ্চর্য সমাধান-প্রচেষ্টা
এই গ্রন্থের মূল আকর্ষণ।
অতি সংক্ষিপ্ত এই কবিতাপম
গদ্যগুলিতে জীবনের কিছু উজ্জ্বল সত্যের চকিত উদ্ভাসন ঘটিয়েছেন বিতান। শেষ পর্বটিতে
তিনি লিখেছেন –“ঘরের ভিতর জানালা খুলে দিই, অগুরু ছাড়াই, ঘুরে ঘুরে
দেখি তোমার নির্মাণ আধেক অন্ধকারে। জানালা দিয়ে আলো এসে পড়লে তোমায় দেখি। দুচোখ
ভরে।” এই মায়াবি গদ্যে তিনি খুলে দিয়েছেন নতুন ভাবনার দ্বার; মানুষের মধ্যেই ‘তিনি’ আছেন, মনের জানালায় আলো এনে ফেললেই ‘তাঁকে’ দেখা যায়। ‘তিনি’ আছেন অসুস্থের সেবায়, শ্রমিকের পরিশ্রমে, মিলনে – বিচ্ছেদে।যে মানুষ সংসারের নিত্য প্রয়োজনে নিজের স্বার্থ নিয়ত বিসর্জন দেয়,
তার চেয়ে ‘বিযুক্ত’ মানুষ আর কোথায় পাবো? রবীন্দ্রনাথ ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে’ দাঁড়ানোর কথা বলেছিলেন। এই অহংমুক্তির বাণী আমাদের
ছোটো ছোটো ত্যাগে, দানে, প্রেমে, স্নেহে প্রতিনিয়ত সংসারের ভিতরেই তো সত্য হয়ে
উঠছে। এই সত্যগুলিকে তীক্ষ্ণ গদ্যে স্বাদু করে তুলেছেন বিতান চক্রবর্তী। তাঁর এই
গ্রন্থটি পাঠকের ভালো লাগবে ও জীবনকে দেখার নতুন দৃষ্টি নিয়ে আসবে বলে বিশ্বাস
করি।
বিভাগীয় প্রধান
শহিদ মাতঙ্গিনী হাজরা গভর্নমেন্ট কলেজ ফর উইমেন
পূর্ব মেদিনীপুর
১।Sengupta, Kiriti; Reflections on Salvation; Transcendent Zero Press, Houston 2016
২। চক্রবর্তী,
বিতান; শান্তিরামের চা ; শাম্ভবী, কলকাতা – ১১০, জানুয়ারি ২০১৬, পৃ -
৮৫
Darun laglo pore.. waiting for my copy
উত্তরমুছুনDarun laglo pore.. waiting for my copy
উত্তরমুছুনbhison bhalo
উত্তরমুছুনঅসাধারণ বিশ্লেষণ...
উত্তরমুছুন