চিহ্ন: ক্ষত আর প্রশমনের নিরন্তর কাহিনি / মুন্সী মহম্মদ ইউনুস
গল্পকার বিতান
চক্রবর্তীর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ “চিহ্ন”। এর বছর দুই আগে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ “শান্তিরামের
চা”। প্রথমটির
মতোই দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থটিরও প্রকাশক শাম্ভবী। সাতটি গল্প নিয়ে সাজানো হয়েছে এই বইটি।
এটুকু নেহাতই
বাইরের তথ্য। আর গল্পগুলো? আলোচনাটা বরং একটু অন্যভাবে শুরু করতে পারি। কেন পড়ব এই
বইটা? পাঠক তো জিঞাসা করতেই
পারেন যে কী এমন আছে এই বইয়ের
গল্পগুলোর মধ্যে যে ‘চিহ্ন’ কিনে পড়তে হবে? মিষ্টি প্রেম আছে? সুড়সুড়ি দেওয়া যৌনতা আছে? মাল্টি-ন্যাশনাল
ন্যারেটিভ আছে? পরকীয়া, পরকীয়া নেই? না, নেই। এর কোনওটাই নেই। আরও অনেক কিছু নেই। সুখী দাম্পত্যের ছবি নেই, দুঃখ-দুঃখ ভাব নেই, দেশ-কাল-সমাজ-সংসার তোলপাড়
করা কাহিনির বর্ণনা নেই। এ-সবের কিচ্ছুটি
নেই।
তবে? তাহলে কেন পড়ব
‘চিহ্ন’? কী আছে এখানে?
বলি তাহলে। বিতানের গল্পের মধ্যে একটা নিরীক্ষণ আছে।
আসলে একজন কথা সাহিত্যিক যখন কোনও চরিত্র বা
ঘটনার নির্মাণ করেন তখন তাকে দেখার চোখটা থাকা খুব জরুরী। বিতানের তা আছে। বিতানের
যে কোনও গল্প পড়লেই বোঝা যায় সেখানে কোনও কিছুই চাপিয়ে দেওয়া নয়, বরং পরিস্থিতির এবং
আখ্যানের প্রয়োজন অনুযায়ী কাহিনি বিবৃত
হয়েছে। গল্পকার যেন একজন দক্ষ শিল্পীর মতো যেখানে
যতটুকু নিয়ন্ত্রণ রাখা দরকার, তাই-ই রেখেছেন। কাজেই বিতানের গল্প পড়লে কোথাও মনে হয় না যে গল্পকার আটঘাট
বেঁধে কোনও গল্প বলার আয়োজন
করেছেন। বরং মনে হয় এক
সংবেদনশীল মেধাবী বন্ধু চায়ের দোকানে এক কাপ চা হাতে নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা
দেওয়ার ফাঁকে কথাগুলো বলে যাচ্ছেন। যদি এমনটা
না হত তাহলে কী করে লেখা সম্ভব হত
‘তোমায় আমায়
মিলে’র মতো
গল্পের? যেখানে কথক এক
নিরাপদ দূরত্ব থেকে ক্রমান্বয়ে দেখে চলেছে, একটি তরুণের অপেক্ষা, তার অস্বস্তি, তার হতাশা, এমনকী আড়ালে থাকা তার জুতোজোড়া পর্যন্ত কথকের দৃষ্টি
এড়ায় না। তরুণীর আসা, তাদের পথ
চলা, সম্পর্কের পাওয়া, না-পাওয়া—এই সব
কিছুর মধ্যে কথক নিজেও আখ্যানের কেন্দ্রভূমিতে ঢুকে পড়ে। বাসের মধ্যে সেই অপরিচিত
লজেন্স বিক্রেতা দাদু যখন তার চামড়া গোটানো মুখ, দু-পাটি দাঁতশূন্য মাড়ি নিয়ে কথকের হাতে তুলে দেয় কাঁচামিঠে আম
গন্ধের লজেন্স তখন এক লহমায় সে ফিরে যায় নিজের শৈশবে।
বিতানের গল্প পাঠের অভিজ্ঞতা থেকে
বলতে পারি, শৈশবের প্রতি গল্পকারের এক অদম্য আকর্ষণ আছে। অত্যন্ত যত্ন-ভালোবাসা দিয়েই এই চরিত্রগুলির নির্মাণ তিনি
করেছেন। কিন্তু একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে, একজন সিরিয়াস সমকালীন গল্পকার হঠাৎ ছোটোদের চরিত্র আনছেন কেন? আমাদের মনে হয়, এটা
গল্পকারের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কারণ ছোটোদের দুনিয়া কপটতাহীন। তা অনেকক্ষেত্রে নির্মম হতে পারে কিন্তু হিপোক্রিট নয়। এই চান্সটাই বিতান নিয়েছেন অত্যন্ত
দক্ষভাবেই। নইলে ‘রোশনাই’ গল্পে যে
প্রশ্নগুলো মৈনাক তার বাবাকে করেছে, সেটা সম্ভব হত না—
‘বাবা, বড়োদিনে সবাই টুনি লাইট দিয়ে
সাজায় কেন?
বা
‘আজ আকাশে তারা ওঠেনি, বাবা’?
শিশুর জবানীতে এই
বিশ্বাসযোগ্য প্রশ্নগুলিই পাঠককে এক বড়ো সত্যের
দিকে নিয়ে যায়।
একজন বুদ্ধিদীপ্ত
গল্পকার হিসেবে বিতান কখনওই
হুড়মুড়িয়ে গল্প বলতে যান না। বরং সল্প পরিসরেই তিনি গল্পকে খুলতে সময় দেন। এই ‘রোশনাই’ গল্পেই
দেখি পরতে পরতে গল্প উন্মোচিত হয়েছে। যেখানে প্রেক্ষাপটে রয়েছে একটি গানের জলসাকে
কেন্দ্র করে এক পরিচিত পাড়া, সেখানে জলসা পরিচালনার দায়িত্বে রাজনৈতিক আশ্রয়ে
পালিত মাস্তানরা। অন্যদিকে এক অসুস্থ মানুষকে নিয়ে গলি রাস্তায় ঢুকে পড়া একটি
অ্যাম্বুলেন্স। তাকে ঘিরে জনতার আক্রোশ। আর এরই মধ্যে এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার।
বাবা আর ছেলের কথপোকথনের মধ্যে উন্মোচিত হয়েছে কাহিনি।
এই শিশুদের নিয়েই বিতান
একটি সম্পূর্ণ গল্প লিখেছেন। ‘তিনটি কয়েন’। অনেক পাঠকই এই
গল্পটিকে ফেলে আসা দিন, নিজেদের শৈশবের
সঙ্গে রিলেট করবেন। কিন্তু আমার কাছে গল্পটি ভীষণ একটা কমপ্লেক্স ন্যরেটিভ বলে মনে
হয়েছে। ঠিকই বিট্টু নামে এক সদ্য কিশোরের যাপন ও আকাঙ্খাকে ঘিরেই এই গল্প গড়ে উঠেছে।
তার চ্যুইংগাম খেয়ে শতখানেক
সচিনের কার্ড দরকার। আর রতনদার দোকানের মোহময় আলুরদম–পাঁউরুটি সে খাবে। কিন্তু উপায়? লক্ষ্মীর
ভাঁড় থেকে পার্থর শেখানো কায়দায় পয়সা বের করা। অনেক কষ্টে সে সফলও হয়। কিন্তু? এই কিন্তুর মধ্যেই গল্পের অন্তর্নিহিত পাঠ লুকিয়ে
আছে। শেষ পর্যন্ত সে পেরে ওঠে না। কয়েন তিনটে
আবার ফিরিয়ে দেয় সেই লক্ষমীর ভাঁড়েই। বিট্টুর এই না পারাটাই অনেক বড় প্রাপ্তি হয়ে
ওঠে পাঠকের কাছে। আসলে সমস্ত রকম জীবনের হয়ে ওঠার মতো অসৎও একভাবে হয়ে ওঠা। আমাদের অনেক রকম চাহিদা আছে। সব তো সফল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না, কাজেই আমাদের বেঁকা পথ ধরতে
হয়, তা অবৈধ হলেও। শিশুদের জগত থেকেই তা শুরু হয়ে যায়। কেউ তার মধ্যে ডুবে যায়,
আবার কেউ তা থেকে বেরিয়ে আসতে সফল হয়। বিট্টু সেই লোভকে জয় করতে পেরেছে। পেরেছে
আমাদের মতো বয়েসে বড়দেরকেও এক জোর ধাক্কা দিতে।
“চিহ্ন” গল্পগ্রন্থের প্রতিটি গল্প পড়লে
আলাদা করে দৃষ্টি আকর্ষণ করে এর চরিত্রগুলি। বিতান তার গল্পের প্রায় প্রতিটি
চরিত্রকেই তুলে এনেছেন রাস্তায় চলতে-ফিরতে। বাস-ট্রেন–চায়ের ঠেক–পাড়া বা আমাদের পরিচিত বাড়ির কোণ থেকে। বিতানের
গল্পে সাজানো ড্রইংরুম নেই, লেট
নাইট পার্টি নেই, বিলাসবহুল গাড়ি নেই, যথেচ্ছ যৌনতা নেই—এই বৃত্তের বাইরেই
বিতান তার চরিত্রদের খুঁজেছেন। আর এর
সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিতানের গল্প বলার আশ্চর্য ক্ষমতা। প্রতিটি গল্পের সঙ্গেই
গল্পকারের অসাধারণ treatment যুক্ত হয়ে গেছে। আলাদা করে দুটো গল্পের কথা
এখানে বলতেই হয়। একটি ‘হারিয়ে যাওয়া’ আর অন্যটি ‘চিহ্ন’। দুটি গল্পের পরিসরই খুব সংক্ষিপ্ত। কিন্তু কী মানবিক এর ব্যখ্যান, কী আন্তরিক এর নির্মাণ। কী অপরিসীম মমতা দিয়ে গল্পকার গড়ে তুলেছেন
কথাগুলো।
যে কোনও সরকারি মানবিক কাজ করতে গেলে মানুষকে ক্ষতি
স্বীকার করতেই হয়। কাজেই উড়াল পুল গড়তে গেলে উচ্ছেদ হয়ে যেতে হয় বস্তি। তেমনই একটা
উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া বস্তির বাসিন্দা ফটিক ও লালি। যারা আমাদের মধ্যবিত্ত দৃষ্টিতে
ছোটোলোক। কিন্তু তাদেরও যে ভালোবাসা আছে,
নির্ভরতা আছে, সংসারের আকাঙ্খা আছে, তার চেষ্টা আছে—এসব কিছুই
দারুণ বিশ্বাসযোগ্যভাবে
তুলে ধরেছেন বিতান। চলমান ট্রেনকে কেন্দ্র করে এক সন্তানসম্ভাবা নারী ও তার
পুরুষের মাঝে পাঠক হতবম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। আর ‘চিহ্ন’গল্পে নকাকার এক প্রশ্নই শেষপর্যন্ত
খেটে-খাওয়া মিস্ত্রি
সুভাষ, আর খেটে-খাওয়া গৃহশিক্ষক ছন্দাকে একই পদচিহ্নে
মিলিয়ে দেয়। বুঝিয়ে দেয়, পৃথিবীর সমস্ত মেহনতি মানুষদের একটাই শ্রেণিপরিচয়। তা সে যতোই আপলিফট্মেন্ট অফ ক্লাসের স্বপ্ন দেখুক না কেন।
বিতানের গল্প পড়তে
গিয়ে আরও একটি উপলব্ধি আমার হয়েছে। তা হল, গল্পকার রাজনৈতিক চেতনায় সমৃদ্ধ। মজার কথা হল, বিতান তার গল্পে কোথাও
সরাসরি রাজনীতির প্রসঙ্গ আনেননি। কিন্ত চাকরিহীন চরিত্র, রাজনৈতিক পার্টি আশ্রিত
মাস্তান, চাকরির মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ঝান্ডা ধরানো,
অবৈধ তকমা দিয়ে লোকের বাসস্থান গুঁড়িয়ে দেওয়া, পার্টির এজেন্টদের দাপট—এই সবই পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে
আমাদের অত্যন্ত পরিচিত। যা সেদিন ছিল, আজও আছে। গুণগতমান দারুণভাবে অক্ষত। ‘ভাঙা
জ্যোৎস্না’ গল্পে যেন তা সম্পূর্ণভাবে উঠে এসেছে। কিন্তু আশার কথা লড়াইটা
ব্যক্তিগত স্তরে শুরু হলেও সঙ্ঘবদ্ধতার ইঙ্গিত
গল্পকার জোরালোভাবেই দিয়েছেন।
সাতটা গল্পের মধ্যে
কেবল ‘অসম্পূর্ণ’গল্পটিকে
ঘিরে কয়েকটি প্রশ্ন থেকে গেল। মনীষা ও বিকাশের সম্পর্কটা বেশ ঝাপসা, গল্পে মাসিমার
কি খুব প্রয়োজন ছিল? আর হ্যাঁ, প্রেমে ধাক্কা খেলেই কি বেশ্যালয়ের ভালো নারীর কাছে
পৌঁছতেই হবে?
আর একটা কথা,
বিতানের সব গল্প পড়তে পড়তে মনে হয়, আর একটু আর একটু তো বলাই যেত। যেন স্বাদ মিটল
না। আমার মনে হয়, বুদ্ধিদীপ্ত গল্পকার এটুকু space তার পাঠকের জন্য
সচেতনভাবেই ছেড়ে রেখেছেন। যাতে করে গল্পপাঠের যাত্রাটা পাঠকেরও হয়ে উঠতে পারে।
শেষ কথায়, একজন
পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়েছে, বিতানের গল্প যেন এক দক্ষ শিল্পীর ধ্রুপদী যন্ত্র যা
আলাপ, থেকে বিস্তার, বিস্তার থেকে ঝালা। কিন্তু তেহাই–এ কখনও পৌঁছায় না। আবার ফিরে আসে উলটো পথে।
“চিহ্ন” পড়ুন। কে জানে, এ অনুভব আপনিও পেয়ে
যেতে পারেন!
সমালোচক জাকির
হোসেন দিল্লি কলেজের (সান্ধ্য শাখা) বাংলা বিভাগের অধ্যাপক।
(দিল্লি ইউনিভার্সিটি)
(দিল্লি ইউনিভার্সিটি)
কোন মন্তব্য নেই