ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে যেসব নারীর নাম জানতেই হয়
By: ফেরারি ওয়েব ডেস্ক
ঝাঁসীর রানি লক্ষী বাঈ
আসল নাম মণিকর্ণিকা তামবে। ডাক নাম মনু। ঝাঁসির মহারাজা গঙ্গাধর রাও নিওয়াকরের সাথে বিবাহের পর নাম হয় লক্ষী বাঈ। ১৮৫৭ সালে মিরাটে সিপাহী বিদ্রোহ সূচনা হয় ওই সময় লক্ষ্মী বাঈ তাঁর সেনাবাহিনীকে নিরাপদে ঝাঁসী ত্যাগ করাতে পেরেছিলেন। তারপর সারা ভারতবর্ষে প্রবল গণআন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
১৮৫৮ সালে
ব্রিটিশ সৈন্যরা স্যার হিউজ রোজের নেতৃত্বে ঝাঁসী অবরোধ করে। লক্ষ্মী
বাঈ সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দেন। অন্যতম বিদ্রোহী নেতা তাতিয়া তোপে এইসময়
ঝাঁসী এবং লক্ষ্মী বাঈকে মুক্ত করতে ২০ হাজার সেনার দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ।
ব্রিটিশদের সৈন্য অনেক কম ছিল ।তবু তাতিয়া তোপে প্রশিক্ষিত ব্রিটিশ সৈনদের অবরোধ
ভাঙ্গতে পারেননি। আক্রমণের তিন দিন পর ব্রিটিশ সেনা দুর্গের দেয়ালে ফাটল ধরায়,
ঝাঁসী দখল করে নেয়। তার আগেই লক্ষ্মী বাঈ দুর্গের দেয়াল থেকে সন্তানসহ লাফ দিয়ে
প্রাণরক্ষা করেন। সেসময় তাঁকে রক্ষা করেছিল একটি নারী সদস্যের দল।
১৭ জুন,
১৮৫৮ সালে ফুল বাগ এলাকায় ব্রিটিশ সেনাদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে লক্ষী বাঈ শহীদ হন ।
বেগম
হজরত মহল
আসল
নাম মহম্মদী খানম। নবাব ওয়াজেদ আলির স্ত্রী বেগম হজরত মহল। তাঁকে ১৮৫৭ সালের
স্বাধীনতা যুদ্ধের আত্মা নামেও অভিহিত করা হয় ।
ভিকাজি
কামা
মাদাম
কামা-র প্রকৃত নাম ছিল ভিকাজি রুস্তম কামা। ভারতের স্বাধীনতার জন্য তিনি ভারতের
বাইরে সক্রিয় ছিলেন। প্রথমদিকে লন্ডন পরে প্যারিসে তিনি কাজ করেন। প্যারিস থেকে
তিনি "বন্দেমাতরম" পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকার
ডিজাইন করেছিলেন তিনি।
বন্দেমাতরম লেখা এই পতাকা লাল, হলুদ, সবুজ এই ত্রি-বর্ণের ছিল। পতাকাটি ১৯০৭ সালে জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে উত্তোলন করেন। বিপ্লবী মত প্রচার ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য তাঁকে "ভারতীয় বিপ্লববাদের
তারা রানী শ্রীবাস্তব
ভারতীয় নারীরা যখন ঘরের বাইরে পা রাখতে পারত না সেই সময় তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত করতে তারা রানী বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন। বিহারে জন্ম নেওয়া এই স্বাধীনতা সংগ্রামী মহাত্মা
গান্ধীর
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নেন। এক প্রতিবাদী মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিজের স্বামী
গুলিবিদ্ধ হন ও মারা যান। কিন্তু তারপরেও তিনি থামেন নি।
কমলাদেবী
চট্টোপাধ্যায়
কমলাদেবী
চট্টোপাধ্যায় ১৯০৩ সালের ৩ এপ্রিল মেঙ্গালুরুতে জন্মগ্রহণ করেন। কমলাদেবি কন্নড়
হলেও বাঙালি হরিন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সাথে খুব কম বয়সে বিয়ে হয়। উচ্চশিক্ষার
জন্য বিদেশে পাড়িও দেন। পরে ফিরে এসে
১৯২৭ সালে যোগ দেন কংগ্রেসে। তিনি ছিলেন
প্রথম মহিলা যিনি ব্রিটিশদের হাতে গ্রেফতার হন। গান্ধিজীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন
তিনি।
অরুণা আসফ আলি
১৯৩০
খ্রিস্টাব্দে লবণ আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে এক বছর কারারুদ্ধ থাকেন। ১৯৩২
খ্রিস্টাব্দে পুনরায় গ্রেপ্তার হন। দিল্লি জেলা জেলে বন্দিদের উপর অত্যাচারের
প্রতিবাদে অনশন করলে তাঁকে গ্রেপ্তার করে আম্বালার নির্জন কারাবাসে রাখা হয়। এই
সময় থেকেই জয়প্রকাশ নারায়ণ, অচ্যুত পটবর্ধন এবং রামমোহন লোহিয়ার সংস্পর্শে এসে
সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণায় উদ্দীপ্ত হতে থাকেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অদম্য
সাহসের জন্য তিনি ‘অগ্নিকন্যা’ নামে পরিচিত হন। ৯ আগস্ট ১৯৪২
খ্রিস্টাব্দে মুম্বাইয়ের গোয়ালিয়া ট্যাঙ্ক ময়দানে (অধুনা মুম্বাইয়ের আগস্ট ক্রান্তি ময়দান) স্বাধীনতার ডাক দিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের কথা ছিল আবুল কালাম আজাদের। তার আগেই গান্ধীজিসহ কংগ্রেসের নেতারা সবাই গ্রেপ্তাার হয়ে গিয়েছিলেন। ময়দানে যখন অধীর জনসমুদ্র তখন ব্রিটিশ পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনি জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে ছুটে এসে তা উত্তোলন করে সেই দিনই ক্রান্তিকন্যারূপে জনসমুদ্রে দুর্বার আন্দোলনের ঢেউ তোলেন। ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে ধরপাকড় এড়িয়ে আত্মগোপন অবস্থায় তিনি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সমাজবাদী সহযোদ্ধাদের সঙ্গে প্রচার পুস্তিকা প্রকাশ করেছেন। স্বাধীনতার পূর্ব মূহূর্ত পর্যন্ত তিনি আত্মগোপন করে ছিলেন।
ক্যাপ্টেন
লক্ষ্মী সেহগল
ভারতের
স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সক্রিয় কর্মী ছিলেন ক্যাপ্টেন ডাক্তার লক্ষ্মী
সেহগল। তিনি ছিলেন ছিলেন সিঙ্গাপুরের এক বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ।
পরে তিনি তাঁর লোভনীয় কর্মজীবন ত্যাগ করে আজাদ হিন্দ ফৌজের রানি ঝাঁসি
রেজিমেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের নারী সংগঠন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীও ছিলেন। বিবাহ-পূর্ব সময়কালীন তাঁর নাম ছিল লক্ষ্মী স্বামীনাথন। লক্ষ্মী সেহগলকে ভারতের জনগণ ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী হিসেবে চিনে থাকেন। বার্মার কারাগারে অবস্থানকালীন সময়ে র্যাংক হিসেবে তাঁকে এ পদবী দেওয়া হয়েছিল।
৯৭ বছর বয়সে ২৩ জুলাই, কানপুরে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তাঁর দেহ কানপুর মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রয়োজনে দান করা হয়।
সুচেতা কৃপালানি
সুচেতা
কৃপলানী ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং রাজনীতিবিদ। তিনি ভারতের প্রথম মহিলা
মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর সমসাময়িক ছিলেন অরুনা আসফ আলি। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় তিনি
সবার সামনে এসেছিলেন। পরে তিনি দেশভাগের দাঙ্গার সময় মহাত্মা গান্ধীর সাথে
ঘনিষ্ঠভাবে কাজ
করেন।
গণপরিষদে নির্বাচিত হওয়া কয়েকজন মহিলার মধ্যে তিনি ছিলেন এবং ভারতীয় সংবিধানের
খসড়া তৈরি করা উপ-কমিটির অংশ ছিলেন। রাজনীতিতে ১৯৭১ সালে বিদায় নেন। ১৯৭৪ সালে
তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি নির্জনতায় থেকে যান।
কস্তুরবা
গাঁধী
মহত্মা
গান্ধীর স্ত্রী কস্তুরবা গান্ধীও একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। প্রথমে
দক্ষিণ আফ্রিকাতে কাজ শুরু করলেও ১৯১৪ সালের জুলাই মাসে কস্তুরবা এবং গান্ধী
দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে ভারতে বাস করতে ফিরে আসেন। কস্তুরবার দীর্ঘস্থায়ী
ব্রঙ্কাইটিস সত্ত্বেও তিনি ভারত জুড়ে নাগরিক ক্রিয়াকলাপ এবং প্রতিবাদে অংশ নিতে
থাকতেন এবং প্রায়শই কারাগারে থাকাকালীন তাঁর স্বামীর স্থান গ্রহণ করেছিলেন।
তাঁর
বেশিরভাগ সময় আশ্রমে তিনি সেবা করতেন। ১৯৩৯ সালে কাস্তুরবা রাজকোটে ব্রিটিশ শাসনের
বিরুদ্ধে অহিংস বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন। কাস্তুরবা এক মাসের জন্য নির্জন কারাগারে
বন্দি ছিলেন। তার স্বাস্থ্য আরও খারাপ হলেও স্বাধীনতার জন্য তিনি লড়াই চালিয়ে
যান। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়।
তিনি পুনের আগা খান প্রাসাদে বন্দি ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে তাঁর স্বাস্থ্যের
মারাত্মকভাবে অবনতি হয়েছিল এবং তিনি পুনের আটক শিবিরে মারা যান।
কমলা নেহরু
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর স্ত্রী ছিলেন তিনি। তিনিও ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। ১৯২১ সালের অসহযোগ আন্দোলনে তিনি এলাহাবাদে মহিলাদের বিভিন্ন দল সংগঠিত করেছিলেন এবং তাঁরা বিদেশি কাপড় ও মদ বিক্রি করার দোকানগুলি তুলে দিতেন।
তিনি পুরো ভারতবর্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামী মহিলাদের দলগুলির
মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার জন্য তাকে
দু’বার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এই সময়কালে তিনি
তাঁর বাড়িতে স্বরাজ ভবনে একটি ডিসপেনসারি শুরু করেছিলেন, আহত সংগ্রামীদের
চিকিৎসার জন্য। তাঁর মৃত্যুর পর সেটি কমলা নেহেরু মেমোরিয়াল হাসপাতাল নামে পরিচিত
হয়।
অ্যানি বেসান্ত
ভারতীয় না হয়েও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক উল্লেখযোগ্য
নারী হলেন অ্যানি বেসান্ত।
তিনি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়ে ভারতের রাজনীতিতেও যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯১৪ সালে যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তখন তিনি ভারতে গণতন্ত্রের
প্রচারে এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের
আধিপত্য রুখতে লোকমান্য তিলকের সাথে হোম রুল লীগ চালু করতে
সহায়তা করেছিলেন। ১৯৩৩ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি ভারতের স্বাধীনতার
জন্য প্রচার চালিয়ে যান।
তথ্যসূত্রঃ অন্তর্জাল, উইকিপিডিয়া
ছবিঃ অন্তর্জাল
কোন মন্তব্য নেই