Header Ads

1 / 5
1 / 5
1 / 5
1 / 5
1 / 5

অতিক্রম / অবিন সেন

এক

একদিন সাহস করে আকাশ হয়ে যাব, ছাদ থেকে টুক করে লাফিয়ে পড়ব, চিৎকার করে দু-হাত মেলে দিয়ে বললআমি মেঘ, আমি মেঘ, বিদ্যুৎ মাখা মেঘ তারপর হি হি করে হাসি টুকাই ট্রেনের জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলহাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ধরতে ধরতে তার কেন যে এ কথা মনে এলো, তা সেই জানে!
টুকাইয়ের মনোজগতে প্রবেশ করার সাধ্য রণিতের নেই, তথাপি সে মাঝে মাঝে এমন বর্ণহীন দেওয়ালের মতো হয়ে যায়, নিঝুম হয়ে যায় যে, মনে হয় এ মন তলহীনটুপ করে এক ফোঁটা বৃষ্টির আঘাতে ক্ষীণ তরঙ্গের হিল্লোলে মূর্ত হয়ে হাসির মতো ভঙ্গিমায় মিলিয়ে যায় সহসাতার পর থেকে সেই যে মুখে কুলুপ এঁটে গুম হয়ে থাকে তা সারাদিন চলে, সে বন্ধ তালা খোলার সাধ্য কারো নেই
সেদিন মাঠে অনেক অঢেল রোদ্দুর, যদিও পড়ন্ত বিকেল, এই বিকেলে খালি পায়ে মাঠে হাঁটলে মনে হয়পতঙ্গদেরও সাহচর্য আছে, সে বড় অনুপমবিকেলে ক্লান্ত ঘাসের গন্ধের সঙ্গে মিশে থাকে ফড়িঙের ডানার সঞ্চারসে তো ফ্রিজের ঠাণ্ডা পেঁয়াজের কলি নয়সে ভাপ দ্যায়, ধান খেতের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যেমন মনে হয় মাঠের থেকে অদৃশ্য এক ভাপএক সাহচর্য উঠে এসে যেন টুকাই ও রণিতের সঙ্গে পথ হাঁটে
এই ভাপের পৃথিবী টুকাইও জানেসে বাবার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে একা একা অনেক দৌড়ল মাঠের আল পথেসন্ধেবেলা ঘরে ফিরতে টুকাইয়ের গায়ে সেই সতেজ মাঠের গন্ধটা পাচ্ছিল না রণিতসে এক অদ্ভুত গন্ধ টুকাইয়ের কথার সঙ্গে হাসির সঙ্গে তার সারা স্বত্বা থেকে বাষ্পের মতো উঠে আসেসেটা না পেলেই রণিত বুঝতে পারে, ছেলের মন ভালো নেইবাপ ছেলের সে এক আশ্চর্য communication.
অথচ টুকাইয়ের ভালো লাগবে ভেবেই রণিতের এই গ্রামের বাড়িতে আসাবাড়িটা রণিতের ঠাকুরদা বানিয়েছিলেনদো-তলা, বাড়িটার চেহারা বিশালপ্রাচীর ঘেরা বিশাল উঠোনছেলেবেলায় সেখানে ভাইবোনেরা মিলে ক্রিকেট খেলত রণিতএখন তার বাবা মা শুধু বুক আগলে পড়ে আছে এই পুরানো বাড়িতেআর রণিতের ছোট কাকাঅবিবাহিততার মেজ কাকা দিল্লীতেবহুকাল হল তাদের শিকড় উপড়ে গিয়েছেরণিত আর তার দাদা রজত পালা করে বাবা মার কাছে আসেএসে কয়েকদিন করে থেকে যায়হেনার সঙ্গে রণিতের ছাড়া ছাড়ি হয়ে যাবার পরে টুকাইকে নিয়ে সে প্রায়ই আসে গ্রামের বাড়িতেটুকাইয়ের গাছপালা ভালো লাগেসবুজ ভালো লাগেরণিতেরও আজ-কাল কলকাতায় দম বন্ধ হয়ে আসেকেন তা সে বুঝতে পারে নাতার কি মন খারাপ ? অথচ একটা ভীষণ রাগে সে নিজেই হেনাকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছিলকিন্তু সেই চণ্ডাল রাগের উপর রনিতের কোন লাগাম নেইঅসহ্য চীৎকার করে করে রণিতের বলতে ইচ্ছা করে নেই নেই না, আমার লাগাম নেইতথাপি কি মহৎ প্রেম, ভালোবাসার পরে তাদের বিয়েটা হয়েছিলতার আর হেনারসেই কলেজের বেলা থেকে আশ্চর্য মায়া আর ভালবাসায় হেনার স্বপ্নকে লালন করেছিল রণিততার পর টুকাইয়ের জন্মঅন্তহীন স্বপ্নের সব দিনআর এখন কি কেবল ঘৃণা ? না, না, রণিত যেন নিজের আয়নার সামনে থেকে সভয়ে সরে আসে—“না, না, ঘৃণা কেন হবে?” কিন্তু রাগ, ভীষণ এক রাগ...রাগের কথা ভাবতে ভাবতে রনিতের ক্লান্তি আসেহেনাকে দূরে সরিয়ে দেবার ক্লান্তি
গ্রামের বাড়িতে রেগুলার লোডশেডিং হয় বলে রণিত গত বছর একটা Inverter লাগিয়ে দিয়েছেকিন্তু টুকাই মাঝে মাঝে বায়না করে হ্যারিকেনের আলোর জন্যহ্যারিকেনের আলো জ্বেলে টুকাই বিছানায় বসে ছিলদেওয়ালে তার দীর্ঘ ছায়াটা দেখছিল রণিতসেই দীর্ঘ ছায়া দেখে রণিতের মনে হচ্ছিল টুকাই যেন কি বিশাল বড় হয়ে গিয়েছেতার মাথা যেন ঘরের ছাদে ঠেকে গিয়েছেরণিত বলল
টুকাই তোমার আকাশ হতে ইচ্ছা করে? ট্রেনে আসতে আসতে বলছিলে ?
টুকাই জানালার কাছে গিয়ে কান খাড়া করে ঝিঁঝিঁর ডাক শুনছিলরণিতের কথা সে শুনল কিনা সেই জানেকিন্তু সে ঘাড় ফেরাতে তার চোখে ওপচানো কৌতূহল দেখল রণিত, তার পর সে ঘাড় ফিরিয়ে নেয়ধীরে ধীরে বলে
বৃষ্টি হতে
তার কথা ক্ষীণ ফিস ফিসের মতো করে শোনায়, তার বলার অভিলাষ অন্ধকারের ভিতর হাত পা মেলে যেন অনেকক্ষণ ভাসে, ভেসে ভেসে রণিতকে মাঝখানে রেখে ঘুরপাক খায়, তখনি একটা চামচিকে কোথা থেকে উড়ে এসে ঘরময় চরকি-পাক খেতে থাকেটুকাই চমকায়ভয় পায়লাফিয়ে সে রণিতের কোলের কাছে সরে আসে, তার ভয় বিহ্বল স্বর রণিতের কানের কাছে ভরসা চেয়ে ফিস ফিস—“বাবা রণিত একহাতে টুকাইকে জড়িয়ে নিয়ে উষ্ণতার অভয় দিতে দিতে দ্যাখে চামচিকেটা তাকে ভেংচি দিতে দিতে জানালা গলে বাইরের অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে 
টুকাই বললে না তো কেন বৃষ্টি হতে চাও?
বৃষ্টি হয়ে মাকে আর তমাকে ভিজিয়ে দেবো
টুকাই খুব ধীরে ধীরে কথা গুলো বলেকেটে কেটে, যেন হাতে করে একটার পরে একটা কথা সাজায় সে!
তার কথায় রণিত যেন থমকে যায়রণিতের চোখের সামনে তার নিজেরই শ্বাসপ্রশ্বাস গুলো সমানে বুদবুদের মতো ভাসতে থাকে, ভেসে ভেসে একের পর এক ফেটে যেতে থাকে
টুকাই নড়ে চড়ে সোজা হয়ে বসেবাবাকে দেখে
বাবা মা কে একটা ফোন করব?
সে অনুমতির অপেক্ষায় রণিতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেতার চোখ ম্লান আলোর মতো নিভু নিভু হয়ে থকেরণিত তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুঝতে পারে তার নিষ্প্রাণ হাত মোবাইল ফোনটা টুকাইয়ের দিকে এগিয়ে দেয়যেন রণিত নয়রণিতের হাতএ ছাড়া রণিতের হাতের যেন কোন উপায় থাকে না
টুকাই ফোন নিয়ে জানালার কাছে সরে যায়ফোনকে আদর করার মতো করে একটু হাত বুলিয়ে নেয়রণিত তার আদরের ভঙ্গি দেখতে পায়একটা ধুপের ধোঁয়ার মতো সুবাসের সেই ভঙ্গিঅন্ধকারেআর সেই সুবাস যেন বদলে গিয়ে অন্ধকারে কাচের গুঁড়োর মতো রণিতের সারা গায়ে বিঁধে যেতে থাকেসে অসহায়ের মতো দেখতে পায় টুকাই গুন গুন করে কথা বলে, কিন্তু তার কথার প্রতিটা পুঙটি রণিতের মনে হয় কাচখন্ডরণিতের হাঁক দিয়ে বলতে ইচ্ছা করে
টুকাই কাচখন্ড ছড়িও না
অন্ধকার যেন রণিতের গলার স্বর শুষে নেয়তাই টুকাই সে কথা শুনতে পায় না
রণিত অসহায়ের মতো বসে থাকে

দুই

স্কুল থেকে ফিরে বাগানে ছোট ছোট গাছগুলিতে জল দিচ্ছিল হেনাদিতে দিতে তার কেমন এক আবেগ লাগছিল স্কুলে পর পর ছটা ক্লাস নিয়ে যে ক্লান্তিটা মাথার ভিতর জমা হয়েছিলো সেটা যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছিলমনে হচ্ছিল তার চারদিকে যেন রঙের বুদ বুদ ভাসে, ভেসে ভেসে তারা তার চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছেতাদের অপরূপ রঙের বাহার যেন অন্তহীন এক টান, তারা তাকে টানছিল, চারপাশ থেকে টানতে টানতে তারা তার আবেগ গুলকে ভেঙ্গে ছত্রখান করছিলহেনা সেই টানের গোলোক ধাঁধার ভিতর পথভ্রষ্ট হয়ে বিমূড়, তার হাতের ঝারি হাতেই অহেতুক রহে গেলো, তার পিছনে সূর্যাস্তক্যানভাস, বিকেলসে কি স্কুলে মীরাদির বলা কথাগুলো ভাবছিল? মিরাদি বলছিল
সুবিমল, বেশ ভাল ছেলে, উদার; তুই কতদিন আর সেই পুরানো ভাঙ্গাচোরা স্বপ্নের ভুত কোলে করে বসে থাকবি!
বিকেলের এই ফাগুনের আলো মাথার কাছে নিয়ে হেনা সুবিমলের কথা ভাবতে বসল, তার কি মাথা খারাপ হল ? কিংবা সেই সব রঙ্গিন বুদবুদ তাকে এক চক্রব্যূহের ভিতর অহেতুক ঘুরিয়ে মারছিল, তা সে ঠিক বুঝতে পারছিল না! বা অকারণ কোনো বসন্ত ঋতু তাকে উত্তেজিত করছিলকিন্তু তখনি টুকাইয়ের মুখখানি তার চোখের সামনে ভেসে উঠেএমনি করেই পৃথিবীর যাবতীয় চঞ্চলতা আলো আর অন্ধকারের রেণুর মতো নশ্বর জীবনের চারপাশে আবর্তিত হয়হেনা সেই আবর্তনের ভিতর দিশা-হীনতার আর কিছু ভাল লাগছিলো নাকতদিন সে টুকাইকে দ্যাখেনিগতকাল টুকাই ফোন করেছিলটুকাই কি বলছিল হেনা তা ভাল করে বুঝতে পারছিল নাটুকাই বৃষ্টির কথা বলছিলবৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ার কথা বলছিলবলছিল—‘মা, তুমি আর বাবা কবে ভিজবে বৃষ্টিতে ? একসাথে? আমিও তবে ভিজব!
হেনা ঠিক বুঝতে পারছিল না, টুকাই কি তবে সময়ের থেকে অনেক বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে ? বড়ো হয়ে আর দৌড়ে সে কি তবে তাকে আর রণিতকে হারিয়ে দেবে ? হেনার কি এই হেরে যাওয়া ভালো লাগবে ? হেনা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না
হেনা আর রণিতের বিয়েটা একটা ভুল বিয়ে বলে মনে করে হেনাভুল ? নিশ্চয়ই ভুল, হেনা নিজের মনের কাছে, আয়নার কাছে কনফেস করতে আর অলীক হচ্ছে না এখন তা হলে বিবাহের এতগুল বছর কি অলীক ? টুকাইয়ের জন্ম, আদরে আবদারে এতোগুলো বছর, সবি কি শীতের রুক্ষ প্রান্তরের মতো কেবল শূন্যের দিকে অন্তহীন? হেনা ভাবতে ভাবতে ভণ্ডুল হয়ে যায়তার মাথার ভিতরটা শালিকের ঝরে পড়া পালকের মতো বয়স্ক মনে হয়সে তখন তার খেলা আর নানা রঙের বুদবুদগুলির কাছে ফিরে আসেতা ছাড়া তার উপায় কি ? টুকাইয়ের স্নেহ মমতা ভিন্ন তার জীবনের সচ্ছলতা কি ? সুবিমল কি তার সমস্ত খেয়ালের বুদবুদ গুলি হাতে তুলে নেবার জন্যে অপেক্ষায় আছে ?
মা, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকছিল হেনাকেহেনা বাগান থেকে শুনতে পাচ্ছিলহেনা বুঝল সুবিমল এসেছেসুবিমল এলে মা এভাবেই উত্তেজিত হয়ে ডাকেযেন হেনা এখুনি দৌড়ে আর হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে না পৌঁছালে বসন্তের সমস্ত দরজা জানালা গুলি বন্ধ হয়ে যাবেমার কাণ্ড দেখলে হেনার হাসি পায়, রাগ হয়হেনা কি পসরার মতো নিজেকে সাজিয়ে তুলবে  সুবিমলের সামনে? হেনার মনে পড়ে, এক কালে রণিতও যখন আসত তখনও মা এমনটাই করতরণিত এখন ছায়ার দিকে সরে গেছে
হেনা দেরি করছিলতার দেরি করতে ইচ্ছা করছিলতার নিজের ঘরে যাবার সময় উঁকি দিয়ে দেখল সুবিমল বসার ঘরে একটা সোফায় পায়ের উপর পা দিয়ে বসে আছেএকটা পত্রিকার পাতা ওলটাচ্ছিলবড্ড অহঙ্কার তার ভঙ্গিঅহঙ্কার দিয়ে সে যেন সকলকে চমকে দিতে চায়হেনা নিজের ঘরে গিয়ে নাইটি বদলে নিয়ে একটা ছাপা শাড়ি পড়লশাদা খোলের উপর হলুদ ফুল ফুল প্রিন্টপাড়ের দিকে অল্প একটু সবুজের ছোঁওয়ানিইটি পরে সে কখনো সুবিমলের সামনে যায় নানাইটিতো কেবল ঘরের মানুষের সামনে পরার জন্যেসুবিমল এখনও হেনার ঘরে-বাইরের দূরত্বে বসে আছেহেনা চুলটা একটা কাঁটা ক্লিপ দিয়ে পিছনদিকে চুড়ো করে নিলোআয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে আঁচল দিয়ে মুখটা একবার মুছে নিলো
বসার ঘরে গিয়ে দেখল মা সুবিমলের সঙ্গে গল্প করছেহেনা ঘরে যেতে মা উৎসুক হয়ে বলল-
এতক্ষণ কোথায় ছিলি রে ? সুবিমল কতক্ষণ বসে আছে
মা ঘরে আলো জ্বেলে দিয়েছেসুবিমল সেই উজ্জ্বল আলোয় হেনাকে দেখছিল
হেনা মৃদু হাসিতে তাকে অভ্যর্থনা করল
হেনা আর সুবিমল যে কথাগুলো বলছিল সে কথাগুলোর কনও উদ্দেশ্য থেকে না, সে গুলো কেবলই অকারণ হাওয়ায় ভেসে ভেসে বেড়াবার মতোযেন চারিদিকে শিমুলের তুলো উড়ে বেড়ায় চৈত্রের শেষ বাতাসেহেনা সেই হালকা ভারহীন তুলো কিছু ধরে নিচ্ছেসুবিমল কিছু ধরে নিয়ে তার পকেটে রেখে দিছেকিংবা কোনও পঠিত পত্রিকার ভিতর সে সেই সব মৃত তুলোর আঁশ গুলিকে জমিয়ে রাখছেএখন তারা মৃতএকদিন তারা রঙ আর আলোয় আন্দোলিত হতএখন তারা কেবল জমে থাকা ফসিলের মতো অনর্গল কথার ভিতর অন্তরীন হয়ে আছে
সুবিমল নিশ্চিত কিছু শুনতে চাইছিল, হেনার কাছে
শরতের প্রান্তরে অঢেল ধানক্ষেতের মতো, নিশ্চিত
কিন্তু হেনার ভিতর কনও নিশ্চয়তা অবশিষ্ট নেইসে ফাগুনের হাওয়ার মতো অস্থিরটুকাই তাকে গতকাল বৃষ্টির কথা বলছিলহেনার ভিতর যেন বৃষ্টির ধারা অঝর ভাবে ঝরছিলঝরছিল এবং ঝরছিলহেনা সুস্থির হয়ে বসে থাকতে পারছিল নাসে বলল
সুবিমল, ঘরের ভিতর যেন দম বন্ধ হয়ে আসছেচলো কোথাও ঘুরে আসি
কোথায় যাবে ?
যেখানে নিয়ে যাবে...
হেনা অদ্ভুত হেসে বলল
সিনেমা যাবে ?
না, না, সিনেমায় আরো দম বন্ধ হয়ে যাবেচলো রাস্তায় হাঁটি


তিন

মার সঙ্গে কথা বলার পর টুকাইয়ের মন পাখির মতো হালকা লাগছিলসে দেওয়ালে লগ্ন তার বৃহৎ ছায়াগুলি দেখছিল, দেওয়ালের সামনে সে হাত পা নাড়ছিলছায়ারাও হাত পা নাড়ছিলটুকাই ছায়ার ভিতরখেলার ভিতর মগ্ন হয়ে যাচ্ছিলরণিত এই সব দেখছিলটুকাইয়ের খেলার ভঙ্গি সে দেখছিলএই সব ভঙ্গি তার চেনা টুকাই যেন তার সমস্ত চেনা আয়না-গুলর সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে আবিষ্কার করছিলতার সেই আবিষ্কার ভোরের বেলা পাখিদের খেলার মতোমাঠ আর মাঠ সংলগ্ন গাছে গাছে যেমন পাখিরা খেলে বেড়ায়তাদের খুশির ডানা সঞ্চার বাতাসের গায়ে আবেগ তৈরি করে, আবেগের বুদবুদবুদবুদের গায়ে আলোর রামধনু হেসে হেসে যেন হেমন্তের সকালকে সচ্ছলতা দ্যায়টুকাইকে দেখে তেমনি মনে হচ্ছিলরণিত যেন টুকাইয়ের ভিতর থেকে সেই সব খেলার সুবাস পাচ্ছিলসেই সুবাস সমস্ত ঘরে ভরে যায়
টুকাই দৌড়ে খেলনা রাখার তাকের কাছে গেলোএকটা খেলনা বন্দুক সে নিয়ে এলোতারপর সে দেওয়ালে লগ্ন ছায়ার দিকে তাক করে ফায়ার করে দিলো, দিয়েই সে বিছানায় হেলে গড়িয়ে পড়লছায়ারাও গড়িয়ে পড়লএকি টুকাইয়ের খেলা না খেলার অভিনয়?
রণিতের ইচ্ছা করছিল টুকাইয়ের সঙ্গে খেলতেকিন্তু খেলার অভিনয় সে ছুতে পারছিল নাসে একটা অস্থিরতার মধ্যে বসেছিলখেলবে কি, খেলবে না! এই দ্বিধা বিভক্ত অনুভব নিয়ে সে বসেছিলভাবছিলহেনার কথাও সে ভাবছিলভাবতে ভাবতে এখন এই মুহূর্তে তার কোনো রাগ হচ্ছিল নাটুকাইয়ের খুশির সুবাসের মধ্যে কি তার সমস্ত রাগ দ্রবীভূত হয়ে যাচ্ছিল? তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না রণিততার কি কনও অপরাধ বোধ জাগছিল মনে ? সে যে টুকাইকে হেনার মায়া মমতার বৃন্ত থেকে উপড়ে নিয়ে চলে এসেছে তার কি অখুশি অনুভব টুকাইয়ের, তাকে কি এক প্রকার ক্লান্ত অপরাধের ভিতর বন্ধ করছিল ? রণিত তা বুঝে উঠতে চেষ্টা করেনি কখনোতাকে কেবলই হেনার প্রতি এক গভীর অভিমান অন্তরিন করে রেখেছেআর তো কয়েক মাস পরেই লেখা পড়া করে তাদের ছাড়া ছাড়ি হয়ে যাবেতখন তো হেনার মুক্তিভাবতে ভাবতেই রণিতের ভিতর সেই গভীর গভীরতর রাগ আবার জন্ম নেয়, বলা ভালো ভেসে ওঠে, ভেসে উঠে যেন যুদ্ধের মতো পল্টন সাজায় সেই চণ্ডাল রাগতার ইচ্ছা করছিল সে টুকাইকে এমন কথাও লুকিয়ে রাখবে যাতে হেনা কখনো খুঁজে না পায়! কিন্তু পরোক্ষনেই সে মুষড়ে পড়েকারণ টুকাই! টুকাইয়ের উপর কি তবে অবিচার হবে না?
হটাত টুকাই তাকে ডাকল
বাবা কি ভাবছ ? খেলবে না ?
খেলব বাবা
তবে বন্দুক নাও
রণিত বন্দুক নিলোনিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে সে টুকাইয়ের দিকে তাকালটুকাইয়ের খেলাটা সে বুঝতে পারছিল না
বাবা, ওই অন্ধকার ছায়াগুলোকে গুলি করে দাও
বলে সে বন্দুক তাক করার ভঙ্গি করে দেখালযেন সে জেনারেল টুকাই, গলা তুলে চিৎকার করে বললফায়ার!
রণিত এবার খেলাটা বুঝতে পারলসে বন্দুকের ট্রিগারে চাপ দিলশব্দ ওলা বন্দুক ঘড় ঘড় করে শব্দ করল
রণিতের মনে হল চারিদিক থেকে যেন এক ঝাঁক পাখি উড়ে গেলোপাখিরা সব ছায়ার থেকে আলোর দিয়ে উড়ে যায় যেনটুকাই হাত তালি দ্যায়সে আবার জেনারেলের মতো ফায়ার করার হুকুম করে
রণিতেরও খুব আমোদ লাগছিলসে যেন ছেলেবেলার অভিনয়ে মেতে উঠেছেতার দুটো মোবাইল ফোন সে বন্ধ করে রেখেছেসে যেন সভ্যতার যাবতীয় যোগাযোগের অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছেঅফিস থেকেও সে ছুটি নিয়ে নিয়েছেএখন শুধু খেলা, কেবল খেলারণিতের পৃথিবীও এখন খেলার পৃথিবীটুকাইয়ের মতো

রণিতের বাবা প্রশান্তবাবু রণিতের এই পরিবর্তন লক্ষ করছিলরণিত প্রায় সপ্তাহ অধিক ছুটি নিয়ে বসে আছেরণিত এতো দিন কেন ছুটি নিয়ে বসে আছে ? কোনো কিছু গোলমাল কি ? তাঁর ভাবনা হয়তা ছাড়া রণিতের মাও বলছিল রণিতের চোখ মুখ যেন বদলে গিয়েছেরণিত যেন সেই আগের উচ্ছল স্বাভাবিক রণিতের ছায়া, কিংবা এক অন্ধকার ছায়ার নীচে যেন রণিত চাপা পড়ে গিয়েছেবুড়ো বয়সে সন্তানের ভাবনায় বাবা মা যেন শতখন্ড হয়ে যাচ্ছেসেভেনটি আপ বয়সেও প্রশান্তবাবু বেশ শক্ত পোক্ত আছেনরোজ সকালে এক ঘণ্টা হাঁটেন, বাগানের পরিচর্যা করেনকিন্তু রণিতের নিয়ে ভাবনা তাকে টুকরো টুকরো করে ফেলছে আজকালবৃদ্ধ বয়েসে একটা অন্ধকার ছায়া যেন তাঁদের ঢেকে ফেলছেহেমন্তের সন্ধ্যার মতো দুঃখী করে রেখেছে তাঁদেরপ্রথম ধাক্কা ছিলো হেনার সঙ্গে রণিতের বিচ্ছেদহেনা তো কতো মায়া মমতায় ভরা মেয়ে ছিলসে বৌমা নয়, মেয়েই ছিল যেন তাঁদের কাছেকিন্তু কি হয়ে গেলো, বা কেন এমন হল এটা নিয়ে অন্ধকারেই আছে প্রশান্তবাবুরণিত ও কিছু বলল নাহেনাও কান্না কাটি করল একদিন ফোন করে, কিন্তু স্পষ্ট করে কিছু বলল নাসে চলে গেলো বাড়ি ছেড়েএখন তাঁরা শুনছেন পাকা পাকি ভাবেই এবার ছাড়া ছাড়ি হয়ে যাবে ওদেরটুকাইয়ের কথা কি কেউ ভাবল না ?
রণিত যখন টুকাইয়ের সঙ্গে খেলছিল তখন প্রশান্তবাবু এলেন রণিতের ঘরে
রণিত তোর অফিসের ছুটি কদিনের ?
রণিত প্রথমটায় যেন শুনতে পায়নিপ্রশান্তবাবু আবার ডাকতে সে চোখ তুলে তাকালযেন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল
ছুটি ?
সে যেন প্রশ্নটা বুঝে উঠতে পারছে না
দিনের ছুটি নিয়েছিস রে ?
বাবা, এখন তো ছুটি! খেলছি দেখছ না !
প্রশান্তবাবু একটা চেয়ারে বসলেন
কি খেলছিস ?
রণিত প্রশ্নটা শুনে টুকাইয়ের দিকে তাকাল
কি খেলা খেলছি বলতো টুকাই ?
যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা
রণিত আবার প্রশান্ত বাবুর দিকে ফিরল, বন্দুক তাক করল
যুদ্ধ!
বলেই ঘড় ঘড় করে বন্দুক চালিয়ে দিলো
রণিত, হেনাকে ডাকবে না এই খেলায় ?
হেনা?
রণিত আবার শূন্য দৃষ্টিতে তাকালযেন সে একটা ভাঙ্গা চোরা সমাধি ফলকের দিকে তাকিয়ে আছেএকটা মৃত সম্পর্কের সমাধিসে আর মৃত কোনো কিছু আস্ত রাখবে না, সব সে বন্দুকের গুলিতে ভেঙ্গে উড়িয়ে দেবেহেনাকে কি সে মনে করতে পারছে না ? নাকি হেনা পুরানো হয়ে গিয়েছে তার কাছে! যেকোনো পুরানো কিছুই মৃত রণিতের কাছেসে সব নতুন করে চায়হেনাও তো পুরানো
প্রশান্তবাবু আবার প্রশ্নটা করলেন
রণিত, হেনাকে নিয়ে খেলবে না ?
না, না, হেনাতো বড় হয়ে গিয়েছে, আর পুরানো, সে খেলতে পারবে ?
রণিতের যেন ভীষণ সন্দেহ হয়
প্রশান্তবাবু অতিস কে ডেকেছিলেনতাঁর বন্ধু, ডাঃ অতিস সোম, পণ্ডিত মানুষডাঃ সোম বাইরে থেকে ডাক দিলেন
প্রশান্ত কোথয়?
প্রশান্তবাবু তাঁকে নিয়ে এসে আর একটা চেয়ারে বসতে দিলেন
রণিত বাবা কেমন আছো ?
রণিত ঘাড় ফেরালো
সোম কাকু কখন এলেন ?
এই, তোএ কি কারেন্ট আছে তো, হ্যারিকেনের আলোয় কি করছ ? প্রশান্ত আলোটা জ্বেলে দাও ভাই !
প্রশান্ত আলোটা জ্বেলে দিলেন
রণিত সহসা চমকে উঠলঝাঁঝিয়ে উঠে বলল
বাবা, আলোটা নিভিয়ে দাও, নিভিয়ে দাও বলছি, আমি খেলছি !
ডাঃ সোম ইশারা করলেন
প্রশান্ত বাবু আলোটা নিভিয়ে দিলেন আবার
ডাঃ সোম গল্প শুরু করলেন রণিতের সঙ্গে
তারা টুক টুক করে অনেক গল্প করলেনযুদ্ধের কথাখেলার কথাহেনার কথাওরণিত বলল, হেনা পুরানো হয়ে গেছে
রনিত আর টুকাই আবার খেলতে থাকল
প্রশান্তবাবু আর ডাঃ সোম বেরিয়ে এলেন
কি বুঝছ সোম ?
প্রশান্ত এ একটা জটিল অবস্থারণিতের মাথার মধ্যে, একটা ওলটপালট ঘটে গেছেকিন্তু সেটা কেন হল সেটা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে
বৌমার সঙ্গে বিচ্ছেদ এর জন্যে কি ?
না তা নয় মনে হয়, এটার জন্যেই বিচ্ছেদ
বৌমাকে একবার আনতে পারবি ? কথা বলব

চার

হেনা যখন সুবিমলের সঙ্গে পথ হেঁটে ফিরল তখন তার মনে হচ্ছিল সে যেন একটা নদীর ধার থেকে ফিরে এলোএকটা সময়ের নদী যেটা কেবল বহে যায়কখনো ফিরে আসেনা মোটেইসে যেন নদী তীরে বসে বসে নদীর কল্লোল শুনছিলসুবিমলের কথা শুনছিলসুবিমল পথ চলতে চলতে অনবরত কথা বলছিলকেবলই বলছিলবলছিল, সে টুকাইকে তাদের কাছে রাখতে চায়তার কথা শুনে হেনার বেশ নিশ্চিন্ত হবার কথা কিন্তু, তা কি সে হতে পারছে? এই চরাচরের সমস্ত আলো ছায়া তাকে যেন ক্রমাগত ঘুরিয়ে মারছেকেবলই ঘুরিয়ে মারছেহেনা কথাও স্থির হয়ে থাকতে পারছে নারণিতকেও তো সে কতো ভালোবাসতোএখনও কি বাসে না ?
হেনা নিজের আয়নার কাছে প্রশ্ন করেআয়না কি মিথ্যা বলে ? তা হলে ? রণিত কেন তাকে দূরে সরিয়ে দিলো? নাকি হেনা নিজেই দূরে সরে এলোরণিত কেমন বদলে গেলোএকদিন খুব মার খেলো হেনাসেদিন রনিতের চোখমুখ দেখে কেমন ভয় পেয়ে গেলো হেনাএকটা আশ্চর্য ভয়তার পর রোজ রোজ ভয়টুকাইয়ের জন্যে একটা খেলনা বন্দুক কিনে এনেছিল হেনাকিন্তু সেটা নিয়ে কেমন ছেলেমানুষের মতো খেলতে শুরু করল রণিত
হেনা যেন রোজ কানের কাছে শুনত—“পালাও হেনা, পালাওএকটা ফাঁকা মাঠের মধ্যে যেন হেনা একাসেই মাঠে একটি মরা আর শুকনো গাছগাছের অজস্র পাখিগুলো বন্দুকের শব্দে পালিয়ে যাচ্ছেউড়ে যাচ্ছেহেনা কোথায় উড়ে যাবে? গাছের শুষ্ক ডালপালা একশ হাত হয়ে তাকে গিলে নিতে আসছেহেনা দৌড়ায়সেই থেকে হেনা ছুটে বেড়ায়নিজের থেকেনিজের ভালবাসার থেকেএকদিন একটা ব্লেড নিয়ে রণিত বলেছিল—“এই হেনা, হেনা, আমার হাতটা কেটে দাও, দ্যাখো যুদ্ধের সৈনিকের গা থেকে কেমন রক্ত পড়ে! হেনা ভয় পায়সে পালাতে চায়রণিত তার চুলের মুঠি ধরে ফিস ফিস করে বলে—“ পালাও হেনা, হেনা মেরি জান, পুরানো মানেই মৃত তুমি!
এ সব দু এক মুহূর্তের প্যাশন রণিতেরপরোক্ষনেই সুস্থির হয়ে যায় সেহেনা ডাক্তারের কথা বলেছিলরণিত আবার রেগে গেছিল আমি কি পাগল? পাগলের  সাথে থেকো না তা হলে
হেনা আলো বন্ধ করে আয়নার সামনে বসে ছিলআয়নায় সে কি অন্ধকারের প্রেত দেখছিল ? একটা ছিন্ন ভিন্ন ভালোবাসার প্রেত সে দেখছিলতখনি শশুর-বাবার ফোন এলোহেনা অনেক্ষন কথা বললপ্রশান্তবাবু সব কথা বললেন, ডাঃ সোমের কথা বললেনশেষে অনেক আকুতি নিয়ে বললেন—“আসবে হেনা? একবার আসবে ?”
হেনা ফোনটা হাতে নিয়ে বসে থাকল চারপাশে তার যেন অঝোর বৃষ্টি ঝরছেবৃষ্টির ভিতরে বৃষ্টি, তার ভিতরে আবার বৃষ্টিতার ভিতর একাধিক বৃষ্টির স্তররণিতের ফোন সুইচ অন করে দিয়েছে প্রশান্তবাবু, হেনা যেন ফোন করেহেনা তাই ফোন হাতে নিয়ে বসে আছেএক রকম অনন্তকাল বসে থাকার মতো তার ভঙ্গিকিন্তু হেনা বুঝে উঠতে পারছে না, সে কি করবে? সে কি করবে ? সুবিমলের তিনবার ফোন এলোহেনা ফোন ধরল নাসুবিমলের ডাক সে শুনতে পাচ্ছিল না
এই রকম কম বেশী অনন্ত, প্রায় সকল মানুষকে অধিকার করে থাকেসেই অধিকারের ভিতর মানুষ কোনো কূল কিনারা পায় নাতখন কি মানুষকে ব্যাধের মতো মনে হয় না! সে বুনো হাসের পিছনে ছুটে বেড়ায়বেড়াতে বেড়াতে সে গ্রাম, শহর, রাজনীতি সকলের সামনেই একবার করে থমকে দাঁড়ায়কিন্তু ভিন্ন সময়ে তার দাঁড়াবার ভঙ্গি ভিন্নসেই নিশ্চিত ভঙ্গিকে সে অস্বীকার করে একটা মাঠে গিয়ে দাঁড়ায়মাঠে মানুষ নেই, গাছপালা নেই, কেবল ছায়াছায়া আর বৃষ্টিকিংবা হেমন্তের মাঠে বৃষ্টি নেইঅথবা আছেহেনা ঠিক জানে নারণিতের গলা ফোনের ভিতর শূন্য মাঠে বাতাসের ফিস ফিসের মতো শুনছে হেনারণিত কিন্তু বৃষ্টির কথা বলছেহেনা দেখছে সেও বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছেহেনার চোখ ঝাপসাসে কিছু দেখতে পাচ্ছে নাবৃষ্টির শব্দে সে কিছু শুনতেও পাচ্ছে নাতার অনন্ত সত্ত্বার ভিতর শুধু সিক্ত এবং রোমাঞ্চিত এক আবেগ অপেক্ষা করে



 এক

একদিন সাহস করে আকাশ হয়ে যাব, ছাদ থেকে টুক করে লাফিয়ে পড়ব, চিৎকার করে দু-হাত মেলে দিয়ে বললআমি মেঘ, আমি মেঘ, বিদ্যুৎ মাখা মেঘ তারপর হি হি করে হাসি টুকাই ট্রেনের জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলহাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ধরতে ধরতে তার কেন যে এ কথা মনে এলো, তা সেই জানে!

টুকাইয়ের মনোজগতে প্রবেশ করার সাধ্য রণিতের নেই, তথাপি সে মাঝে মাঝে এমন বর্ণহীন দেওয়ালের মতো হয়ে যায়, নিঝুম হয়ে যায় যে, মনে হয় এ মন তলহীনটুপ করে এক ফোঁটা বৃষ্টির আঘাতে ক্ষীণ তরঙ্গের হিল্লোলে মূর্ত হয়ে হাসির মতো ভঙ্গিমায় মিলিয়ে যায় সহসাতার পর থেকে সেই যে মুখে কুলুপ এঁটে গুম হয়ে থাকে তা সারাদিন চলে, সে বন্ধ তালা খোলার সাধ্য কারো নেই

সেদিন মাঠে অনেক অঢেল রোদ্দুর, যদিও পড়ন্ত বিকেল, এই বিকেলে খালি পায়ে মাঠে হাঁটলে মনে হয়পতঙ্গদেরও সাহচর্য আছে, সে বড় অনুপমবিকেলে ক্লান্ত ঘাসের গন্ধের সঙ্গে মিশে থাকে ফড়িঙের ডানার সঞ্চারসে তো ফ্রিজের ঠাণ্ডা পেঁয়াজের কলি নয়সে ভাপ দ্যায়, ধান খেতের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যেমন মনে হয় মাঠের থেকে অদৃশ্য এক ভাপএক সাহচর্য উঠে এসে যেন টুকাই ও রণিতের সঙ্গে পথ হাঁটে

এই ভাপের পৃথিবী টুকাইও জানেসে বাবার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে একা একা অনেক দৌড়ল মাঠের আল পথেসন্ধেবেলা ঘরে ফিরতে টুকাইয়ের গায়ে সেই সতেজ মাঠের গন্ধটা পাচ্ছিল না রণিতসে এক অদ্ভুত গন্ধ টুকাইয়ের কথার সঙ্গে হাসির সঙ্গে তার সারা স্বত্বা থেকে বাষ্পের মতো উঠে আসেসেটা না পেলেই রণিত বুঝতে পারে, ছেলের মন ভালো নেইবাপ ছেলের সে এক আশ্চর্য communication.

অথচ টুকাইয়ের ভালো লাগবে ভেবেই রণিতের এই গ্রামের বাড়িতে আসাবাড়িটা রণিতের ঠাকুরদা বানিয়েছিলেনদো-তলা, বাড়িটার চেহারা বিশালপ্রাচীর ঘেরা বিশাল উঠোনছেলেবেলায় সেখানে ভাইবোনেরা মিলে ক্রিকেট খেলত রণিতএখন তার বাবা মা শুধু বুক আগলে পড়ে আছে এই পুরানো বাড়িতেআর রণিতের ছোট কাকাঅবিবাহিততার মেজ কাকা দিল্লীতেবহুকাল হল তাদের শিকড় উপড়ে গিয়েছেরণিত আর তার দাদা রজত পালা করে বাবা মার কাছে আসেএসে কয়েকদিন করে থেকে যায়হেনার সঙ্গে রণিতের ছাড়া ছাড়ি হয়ে যাবার পরে টুকাইকে নিয়ে সে প্রায়ই আসে গ্রামের বাড়িতেটুকাইয়ের গাছপালা ভালো লাগেসবুজ ভালো লাগেরণিতেরও আজ-কাল কলকাতায় দম বন্ধ হয়ে আসেকেন তা সে বুঝতে পারে নাতার কি মন খারাপ ? অথচ একটা ভীষণ রাগে সে নিজেই হেনাকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছিলকিন্তু সেই চণ্ডাল রাগের উপর রনিতের কোন লাগাম নেইঅসহ্য চীৎকার করে করে রণিতের বলতে ইচ্ছা করে নেই নেই না, আমার লাগাম নেইতথাপি কি মহৎ প্রেম, ভালোবাসার পরে তাদের বিয়েটা হয়েছিলতার আর হেনারসেই কলেজের বেলা থেকে আশ্চর্য মায়া আর ভালবাসায় হেনার স্বপ্নকে লালন করেছিল রণিততার পর টুকাইয়ের জন্মঅন্তহীন স্বপ্নের সব দিনআর এখন কি কেবল ঘৃণা ? না, না, রণিত যেন নিজের আয়নার সামনে থেকে সভয়ে সরে আসে—“না, না, ঘৃণা কেন হবে?” কিন্তু রাগ, ভীষণ এক রাগ...রাগের কথা ভাবতে ভাবতে রনিতের ক্লান্তি আসেহেনাকে দূরে সরিয়ে দেবার ক্লান্তি

গ্রামের বাড়িতে রেগুলার লোডশেডিং হয় বলে রণিত গত বছর একটা Inverter লাগিয়ে দিয়েছেকিন্তু টুকাই মাঝে মাঝে বায়না করে হ্যারিকেনের আলোর জন্যহ্যারিকেনের আলো জ্বেলে টুকাই বিছানায় বসে ছিলদেওয়ালে তার দীর্ঘ ছায়াটা দেখছিল রণিতসেই দীর্ঘ ছায়া দেখে রণিতের মনে হচ্ছিল টুকাই যেন কি বিশাল বড় হয়ে গিয়েছেতার মাথা যেন ঘরের ছাদে ঠেকে গিয়েছেরণিত বলল

টুকাই তোমার আকাশ হতে ইচ্ছা করে? ট্রেনে আসতে আসতে বলছিলে ?

টুকাই জানালার কাছে গিয়ে কান খাড়া করে ঝিঁঝিঁর ডাক শুনছিলরণিতের কথা সে শুনল কিনা সেই জানেকিন্তু সে ঘাড় ফেরাতে তার চোখে ওপচানো কৌতূহল দেখল রণিত, তার পর সে ঘাড় ফিরিয়ে নেয়ধীরে ধীরে বলে

বৃষ্টি হতে

তার কথা ক্ষীণ ফিস ফিসের মতো করে শোনায়, তার বলার অভিলাষ অন্ধকারের ভিতর হাত পা মেলে যেন অনেকক্ষণ ভাসে, ভেসে ভেসে রণিতকে মাঝখানে রেখে ঘুরপাক খায়, তখনি একটা চামচিকে কোথা থেকে উড়ে এসে ঘরময় চরকি-পাক খেতে থাকেটুকাই চমকায়ভয় পায়লাফিয়ে সে রণিতের কোলের কাছে সরে আসে, তার ভয় বিহ্বল স্বর রণিতের কানের কাছে ভরসা চেয়ে ফিস ফিস—“বাবা রণিত একহাতে টুকাইকে জড়িয়ে নিয়ে উষ্ণতার অভয় দিতে দিতে দ্যাখে চামচিকেটা তাকে ভেংচি দিতে দিতে জানালা গলে বাইরের অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে 

টুকাই বললে না তো কেন বৃষ্টি হতে চাও?

বৃষ্টি হয়ে মাকে আর তমাকে ভিজিয়ে দেবো

টুকাই খুব ধীরে ধীরে কথা গুলো বলেকেটে কেটে, যেন হাতে করে একটার পরে একটা কথা সাজায় সে!

তার কথায় রণিত যেন থমকে যায়রণিতের চোখের সামনে তার নিজেরই শ্বাসপ্রশ্বাস গুলো সমানে বুদবুদের মতো ভাসতে থাকে, ভেসে ভেসে একের পর এক ফেটে যেতে থাকে

টুকাই নড়ে চড়ে সোজা হয়ে বসেবাবাকে দেখে

বাবা মা কে একটা ফোন করব?

সে অনুমতির অপেক্ষায় রণিতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেতার চোখ ম্লান আলোর মতো নিভু নিভু হয়ে থকেরণিত তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুঝতে পারে তার নিষ্প্রাণ হাত মোবাইল ফোনটা টুকাইয়ের দিকে এগিয়ে দেয়যেন রণিত নয়রণিতের হাতএ ছাড়া রণিতের হাতের যেন কোন উপায় থাকে না

টুকাই ফোন নিয়ে জানালার কাছে সরে যায়ফোনকে আদর করার মতো করে একটু হাত বুলিয়ে নেয়রণিত তার আদরের ভঙ্গি দেখতে পায়একটা ধুপের ধোঁয়ার মতো সুবাসের সেই ভঙ্গিঅন্ধকারেআর সেই সুবাস যেন বদলে গিয়ে অন্ধকারে কাচের গুঁড়োর মতো রণিতের সারা গায়ে বিঁধে যেতে থাকেসে অসহায়ের মতো দেখতে পায় টুকাই গুন গুন করে কথা বলে, কিন্তু তার কথার প্রতিটা পুঙটি রণিতের মনে হয় কাচখন্ডরণিতের হাঁক দিয়ে বলতে ইচ্ছা করে

টুকাই কাচখন্ড ছড়িও না

অন্ধকার যেন রণিতের গলার স্বর শুষে নেয়তাই টুকাই সে কথা শুনতে পায় না

রণিত অসহায়ের মতো বসে থাকে


দুই


স্কুল থেকে ফিরে বাগানে ছোট ছোট গাছগুলিতে জল দিচ্ছিল হেনাদিতে দিতে তার কেমন এক আবেগ লাগছিল স্কুলে পর পর ছটা ক্লাস নিয়ে যে ক্লান্তিটা মাথার ভিতর জমা হয়েছিলো সেটা যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছিলমনে হচ্ছিল তার চারদিকে যেন রঙের বুদ বুদ ভাসে, ভেসে ভেসে তারা তার চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছেতাদের অপরূপ রঙের বাহার যেন অন্তহীন এক টান, তারা তাকে টানছিল, চারপাশ থেকে টানতে টানতে তারা তার আবেগ গুলকে ভেঙ্গে ছত্রখান করছিলহেনা সেই টানের গোলোক ধাঁধার ভিতর পথভ্রষ্ট হয়ে বিমূড়, তার হাতের ঝারি হাতেই অহেতুক রহে গেলো, তার পিছনে সূর্যাস্তক্যানভাস, বিকেলসে কি স্কুলে মীরাদির বলা কথাগুলো ভাবছিল? মিরাদি বলছিল

সুবিমল, বেশ ভাল ছেলে, উদার; তুই কতদিন আর সেই পুরানো ভাঙ্গাচোরা স্বপ্নের ভুত কোলে করে বসে থাকবি!

বিকেলের এই ফাগুনের আলো মাথার কাছে নিয়ে হেনা সুবিমলের কথা ভাবতে বসল, তার কি মাথা খারাপ হল ? কিংবা সেই সব রঙ্গিন বুদবুদ তাকে এক চক্রব্যূহের ভিতর অহেতুক ঘুরিয়ে মারছিল, তা সে ঠিক বুঝতে পারছিল না! বা অকারণ কোনো বসন্ত ঋতু তাকে উত্তেজিত করছিলকিন্তু তখনি টুকাইয়ের মুখখানি তার চোখের সামনে ভেসে উঠেএমনি করেই পৃথিবীর যাবতীয় চঞ্চলতা আলো আর অন্ধকারের রেণুর মতো নশ্বর জীবনের চারপাশে আবর্তিত হয়হেনা সেই আবর্তনের ভিতর দিশা-হীনতার আর কিছু ভাল লাগছিলো নাকতদিন সে টুকাইকে দ্যাখেনিগতকাল টুকাই ফোন করেছিলটুকাই কি বলছিল হেনা তা ভাল করে বুঝতে পারছিল নাটুকাই বৃষ্টির কথা বলছিলবৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ার কথা বলছিলবলছিল—‘মা, তুমি আর বাবা কবে ভিজবে বৃষ্টিতে ? একসাথে? আমিও তবে ভিজব!

হেনা ঠিক বুঝতে পারছিল না, টুকাই কি তবে সময়ের থেকে অনেক বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে ? বড়ো হয়ে আর দৌড়ে সে কি তবে তাকে আর রণিতকে হারিয়ে দেবে ? হেনার কি এই হেরে যাওয়া ভালো লাগবে ? হেনা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না

হেনা আর রণিতের বিয়েটা একটা ভুল বিয়ে বলে মনে করে হেনাভুল ? নিশ্চয়ই ভুল, হেনা নিজের মনের কাছে, আয়নার কাছে কনফেস করতে আর অলীক হচ্ছে না এখন তা হলে বিবাহের এতগুল বছর কি অলীক ? টুকাইয়ের জন্ম, আদরে আবদারে এতোগুলো বছর, সবি কি শীতের রুক্ষ প্রান্তরের মতো কেবল শূন্যের দিকে অন্তহীন? হেনা ভাবতে ভাবতে ভণ্ডুল হয়ে যায়তার মাথার ভিতরটা শালিকের ঝরে পড়া পালকের মতো বয়স্ক মনে হয়সে তখন তার খেলা আর নানা রঙের বুদবুদগুলির কাছে ফিরে আসেতা ছাড়া তার উপায় কি ? টুকাইয়ের স্নেহ মমতা ভিন্ন তার জীবনের সচ্ছলতা কি ? সুবিমল কি তার সমস্ত খেয়ালের বুদবুদ গুলি হাতে তুলে নেবার জন্যে অপেক্ষায় আছে ?

মা, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকছিল হেনাকেহেনা বাগান থেকে শুনতে পাচ্ছিলহেনা বুঝল সুবিমল এসেছেসুবিমল এলে মা এভাবেই উত্তেজিত হয়ে ডাকেযেন হেনা এখুনি দৌড়ে আর হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে না পৌঁছালে বসন্তের সমস্ত দরজা জানালা গুলি বন্ধ হয়ে যাবেমার কাণ্ড দেখলে হেনার হাসি পায়, রাগ হয়হেনা কি পসরার মতো নিজেকে সাজিয়ে তুলবে  সুবিমলের সামনে? হেনার মনে পড়ে, এক কালে রণিতও যখন আসত তখনও মা এমনটাই করতরণিত এখন ছায়ার দিকে সরে গেছে

হেনা দেরি করছিলতার দেরি করতে ইচ্ছা করছিলতার নিজের ঘরে যাবার সময় উঁকি দিয়ে দেখল সুবিমল বসার ঘরে একটা সোফায় পায়ের উপর পা দিয়ে বসে আছেএকটা পত্রিকার পাতা ওলটাচ্ছিলবড্ড অহঙ্কার তার ভঙ্গিঅহঙ্কার দিয়ে সে যেন সকলকে চমকে দিতে চায়হেনা নিজের ঘরে গিয়ে নাইটি বদলে নিয়ে একটা ছাপা শাড়ি পড়লশাদা খোলের উপর হলুদ ফুল ফুল প্রিন্টপাড়ের দিকে অল্প একটু সবুজের ছোঁওয়ানিইটি পরে সে কখনো সুবিমলের সামনে যায় নানাইটিতো কেবল ঘরের মানুষের সামনে পরার জন্যেসুবিমল এখনও হেনার ঘরে-বাইরের দূরত্বে বসে আছেহেনা চুলটা একটা কাঁটা ক্লিপ দিয়ে পিছনদিকে চুড়ো করে নিলোআয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে আঁচল দিয়ে মুখটা একবার মুছে নিলো

বসার ঘরে গিয়ে দেখল মা সুবিমলের সঙ্গে গল্প করছেহেনা ঘরে যেতে মা উৎসুক হয়ে বলল-

এতক্ষণ কোথায় ছিলি রে ? সুবিমল কতক্ষণ বসে আছে

মা ঘরে আলো জ্বেলে দিয়েছেসুবিমল সেই উজ্জ্বল আলোয় হেনাকে দেখছিল

হেনা মৃদু হাসিতে তাকে অভ্যর্থনা করল

হেনা আর সুবিমল যে কথাগুলো বলছিল সে কথাগুলোর কনও উদ্দেশ্য থেকে না, সে গুলো কেবলই অকারণ হাওয়ায় ভেসে ভেসে বেড়াবার মতোযেন চারিদিকে শিমুলের তুলো উড়ে বেড়ায় চৈত্রের শেষ বাতাসেহেনা সেই হালকা ভারহীন তুলো কিছু ধরে নিচ্ছেসুবিমল কিছু ধরে নিয়ে তার পকেটে রেখে দিছেকিংবা কোনও পঠিত পত্রিকার ভিতর সে সেই সব মৃত তুলোর আঁশ গুলিকে জমিয়ে রাখছেএখন তারা মৃতএকদিন তারা রঙ আর আলোয় আন্দোলিত হতএখন তারা কেবল জমে থাকা ফসিলের মতো অনর্গল কথার ভিতর অন্তরীন হয়ে আছে

সুবিমল নিশ্চিত কিছু শুনতে চাইছিল, হেনার কাছে

শরতের প্রান্তরে অঢেল ধানক্ষেতের মতো, নিশ্চিত

কিন্তু হেনার ভিতর কনও নিশ্চয়তা অবশিষ্ট নেইসে ফাগুনের হাওয়ার মতো অস্থিরটুকাই তাকে গতকাল বৃষ্টির কথা বলছিলহেনার ভিতর যেন বৃষ্টির ধারা অঝর ভাবে ঝরছিলঝরছিল এবং ঝরছিলহেনা সুস্থির হয়ে বসে থাকতে পারছিল নাসে বলল

সুবিমল, ঘরের ভিতর যেন দম বন্ধ হয়ে আসছেচলো কোথাও ঘুরে আসি

কোথায় যাবে ?

যেখানে নিয়ে যাবে...

হেনা অদ্ভুত হেসে বলল

সিনেমা যাবে ?

না, না, সিনেমায় আরো দম বন্ধ হয়ে যাবেচলো রাস্তায় হাঁটি



তিন


মার সঙ্গে কথা বলার পর টুকাইয়ের মন পাখির মতো হালকা লাগছিলসে দেওয়ালে লগ্ন তার বৃহৎ ছায়াগুলি দেখছিল, দেওয়ালের সামনে সে হাত পা নাড়ছিলছায়ারাও হাত পা নাড়ছিলটুকাই ছায়ার ভিতরখেলার ভিতর মগ্ন হয়ে যাচ্ছিলরণিত এই সব দেখছিলটুকাইয়ের খেলার ভঙ্গি সে দেখছিলএই সব ভঙ্গি তার চেনা টুকাই যেন তার সমস্ত চেনা আয়না-গুলর সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে আবিষ্কার করছিলতার সেই আবিষ্কার ভোরের বেলা পাখিদের খেলার মতোমাঠ আর মাঠ সংলগ্ন গাছে গাছে যেমন পাখিরা খেলে বেড়ায়তাদের খুশির ডানা সঞ্চার বাতাসের গায়ে আবেগ তৈরি করে, আবেগের বুদবুদবুদবুদের গায়ে আলোর রামধনু হেসে হেসে যেন হেমন্তের সকালকে সচ্ছলতা দ্যায়টুকাইকে দেখে তেমনি মনে হচ্ছিলরণিত যেন টুকাইয়ের ভিতর থেকে সেই সব খেলার সুবাস পাচ্ছিলসেই সুবাস সমস্ত ঘরে ভরে যায়

টুকাই দৌড়ে খেলনা রাখার তাকের কাছে গেলোএকটা খেলনা বন্দুক সে নিয়ে এলোতারপর সে দেওয়ালে লগ্ন ছায়ার দিকে তাক করে ফায়ার করে দিলো, দিয়েই সে বিছানায় হেলে গড়িয়ে পড়লছায়ারাও গড়িয়ে পড়লএকি টুকাইয়ের খেলা না খেলার অভিনয়?

রণিতের ইচ্ছা করছিল টুকাইয়ের সঙ্গে খেলতেকিন্তু খেলার অভিনয় সে ছুতে পারছিল নাসে একটা অস্থিরতার মধ্যে বসেছিলখেলবে কি, খেলবে না! এই দ্বিধা বিভক্ত অনুভব নিয়ে সে বসেছিলভাবছিলহেনার কথাও সে ভাবছিলভাবতে ভাবতে এখন এই মুহূর্তে তার কোনো রাগ হচ্ছিল নাটুকাইয়ের খুশির সুবাসের মধ্যে কি তার সমস্ত রাগ দ্রবীভূত হয়ে যাচ্ছিল? তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না রণিততার কি কনও অপরাধ বোধ জাগছিল মনে ? সে যে টুকাইকে হেনার মায়া মমতার বৃন্ত থেকে উপড়ে নিয়ে চলে এসেছে তার কি অখুশি অনুভব টুকাইয়ের, তাকে কি এক প্রকার ক্লান্ত অপরাধের ভিতর বন্ধ করছিল ? রণিত তা বুঝে উঠতে চেষ্টা করেনি কখনোতাকে কেবলই হেনার প্রতি এক গভীর অভিমান অন্তরিন করে রেখেছেআর তো কয়েক মাস পরেই লেখা পড়া করে তাদের ছাড়া ছাড়ি হয়ে যাবেতখন তো হেনার মুক্তিভাবতে ভাবতেই রণিতের ভিতর সেই গভীর গভীরতর রাগ আবার জন্ম নেয়, বলা ভালো ভেসে ওঠে, ভেসে উঠে যেন যুদ্ধের মতো পল্টন সাজায় সেই চণ্ডাল রাগতার ইচ্ছা করছিল সে টুকাইকে এমন কথাও লুকিয়ে রাখবে যাতে হেনা কখনো খুঁজে না পায়! কিন্তু পরোক্ষনেই সে মুষড়ে পড়েকারণ টুকাই! টুকাইয়ের উপর কি তবে অবিচার হবে না?

হটাত টুকাই তাকে ডাকল

বাবা কি ভাবছ ? খেলবে না ?

খেলব বাবা

তবে বন্দুক নাও

রণিত বন্দুক নিলোনিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে সে টুকাইয়ের দিকে তাকালটুকাইয়ের খেলাটা সে বুঝতে পারছিল না

বাবা, ওই অন্ধকার ছায়াগুলোকে গুলি করে দাও

বলে সে বন্দুক তাক করার ভঙ্গি করে দেখালযেন সে জেনারেল টুকাই, গলা তুলে চিৎকার করে বললফায়ার!

রণিত এবার খেলাটা বুঝতে পারলসে বন্দুকের ট্রিগারে চাপ দিলশব্দ ওলা বন্দুক ঘড় ঘড় করে শব্দ করল

রণিতের মনে হল চারিদিক থেকে যেন এক ঝাঁক পাখি উড়ে গেলোপাখিরা সব ছায়ার থেকে আলোর দিয়ে উড়ে যায় যেনটুকাই হাত তালি দ্যায়সে আবার জেনারেলের মতো ফায়ার করার হুকুম করে

রণিতেরও খুব আমোদ লাগছিলসে যেন ছেলেবেলার অভিনয়ে মেতে উঠেছেতার দুটো মোবাইল ফোন সে বন্ধ করে রেখেছেসে যেন সভ্যতার যাবতীয় যোগাযোগের অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছেঅফিস থেকেও সে ছুটি নিয়ে নিয়েছেএখন শুধু খেলা, কেবল খেলারণিতের পৃথিবীও এখন খেলার পৃথিবীটুকাইয়ের মতো


রণিতের বাবা প্রশান্তবাবু রণিতের এই পরিবর্তন লক্ষ করছিলরণিত প্রায় সপ্তাহ অধিক ছুটি নিয়ে বসে আছেরণিত এতো দিন কেন ছুটি নিয়ে বসে আছে ? কোনো কিছু গোলমাল কি ? তাঁর ভাবনা হয়তা ছাড়া রণিতের মাও বলছিল রণিতের চোখ মুখ যেন বদলে গিয়েছেরণিত যেন সেই আগের উচ্ছল স্বাভাবিক রণিতের ছায়া, কিংবা এক অন্ধকার ছায়ার নীচে যেন রণিত চাপা পড়ে গিয়েছেবুড়ো বয়সে সন্তানের ভাবনায় বাবা মা যেন শতখন্ড হয়ে যাচ্ছেসেভেনটি আপ বয়সেও প্রশান্তবাবু বেশ শক্ত পোক্ত আছেনরোজ সকালে এক ঘণ্টা হাঁটেন, বাগানের পরিচর্যা করেনকিন্তু রণিতের নিয়ে ভাবনা তাকে টুকরো টুকরো করে ফেলছে আজকালবৃদ্ধ বয়েসে একটা অন্ধকার ছায়া যেন তাঁদের ঢেকে ফেলছেহেমন্তের সন্ধ্যার মতো দুঃখী করে রেখেছে তাঁদেরপ্রথম ধাক্কা ছিলো হেনার সঙ্গে রণিতের বিচ্ছেদহেনা তো কতো মায়া মমতায় ভরা মেয়ে ছিলসে বৌমা নয়, মেয়েই ছিল যেন তাঁদের কাছেকিন্তু কি হয়ে গেলো, বা কেন এমন হল এটা নিয়ে অন্ধকারেই আছে প্রশান্তবাবুরণিত ও কিছু বলল নাহেনাও কান্না কাটি করল একদিন ফোন করে, কিন্তু স্পষ্ট করে কিছু বলল নাসে চলে গেলো বাড়ি ছেড়েএখন তাঁরা শুনছেন পাকা পাকি ভাবেই এবার ছাড়া ছাড়ি হয়ে যাবে ওদেরটুকাইয়ের কথা কি কেউ ভাবল না ?

রণিত যখন টুকাইয়ের সঙ্গে খেলছিল তখন প্রশান্তবাবু এলেন রণিতের ঘরে

রণিত তোর অফিসের ছুটি কদিনের ?

রণিত প্রথমটায় যেন শুনতে পায়নিপ্রশান্তবাবু আবার ডাকতে সে চোখ তুলে তাকালযেন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল

ছুটি ?

সে যেন প্রশ্নটা বুঝে উঠতে পারছে না

দিনের ছুটি নিয়েছিস রে ?

বাবা, এখন তো ছুটি! খেলছি দেখছ না !

প্রশান্তবাবু একটা চেয়ারে বসলেন

কি খেলছিস ?

রণিত প্রশ্নটা শুনে টুকাইয়ের দিকে তাকাল

কি খেলা খেলছি বলতো টুকাই ?

যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা

রণিত আবার প্রশান্ত বাবুর দিকে ফিরল, বন্দুক তাক করল

যুদ্ধ!

বলেই ঘড় ঘড় করে বন্দুক চালিয়ে দিলো

রণিত, হেনাকে ডাকবে না এই খেলায় ?

হেনা?

রণিত আবার শূন্য দৃষ্টিতে তাকালযেন সে একটা ভাঙ্গা চোরা সমাধি ফলকের দিকে তাকিয়ে আছেএকটা মৃত সম্পর্কের সমাধিসে আর মৃত কোনো কিছু আস্ত রাখবে না, সব সে বন্দুকের গুলিতে ভেঙ্গে উড়িয়ে দেবেহেনাকে কি সে মনে করতে পারছে না ? নাকি হেনা পুরানো হয়ে গিয়েছে তার কাছে! যেকোনো পুরানো কিছুই মৃত রণিতের কাছেসে সব নতুন করে চায়হেনাও তো পুরানো

প্রশান্তবাবু আবার প্রশ্নটা করলেন

রণিত, হেনাকে নিয়ে খেলবে না ?

না, না, হেনাতো বড় হয়ে গিয়েছে, আর পুরানো, সে খেলতে পারবে ?

রণিতের যেন ভীষণ সন্দেহ হয়

প্রশান্তবাবু অতিস কে ডেকেছিলেনতাঁর বন্ধু, ডাঃ অতিস সোম, পণ্ডিত মানুষডাঃ সোম বাইরে থেকে ডাক দিলেন

প্রশান্ত কোথয়?

প্রশান্তবাবু তাঁকে নিয়ে এসে আর একটা চেয়ারে বসতে দিলেন

রণিত বাবা কেমন আছো ?

রণিত ঘাড় ফেরালো

সোম কাকু কখন এলেন ?

এই, তোএ কি কারেন্ট আছে তো, হ্যারিকেনের আলোয় কি করছ ? প্রশান্ত আলোটা জ্বেলে দাও ভাই !

প্রশান্ত আলোটা জ্বেলে দিলেন

রণিত সহসা চমকে উঠলঝাঁঝিয়ে উঠে বলল

বাবা, আলোটা নিভিয়ে দাও, নিভিয়ে দাও বলছি, আমি খেলছি !

ডাঃ সোম ইশারা করলেন

প্রশান্ত বাবু আলোটা নিভিয়ে দিলেন আবার

ডাঃ সোম গল্প শুরু করলেন রণিতের সঙ্গে

তারা টুক টুক করে অনেক গল্প করলেনযুদ্ধের কথাখেলার কথাহেনার কথাওরণিত বলল, হেনা পুরানো হয়ে গেছে

রনিত আর টুকাই আবার খেলতে থাকল

প্রশান্তবাবু আর ডাঃ সোম বেরিয়ে এলেন

কি বুঝছ সোম ?

প্রশান্ত এ একটা জটিল অবস্থারণিতের মাথার মধ্যে, একটা ওলটপালট ঘটে গেছেকিন্তু সেটা কেন হল সেটা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে

বৌমার সঙ্গে বিচ্ছেদ এর জন্যে কি ?

না তা নয় মনে হয়, এটার জন্যেই বিচ্ছেদ

বৌমাকে একবার আনতে পারবি ? কথা বলব


চার


হেনা যখন সুবিমলের সঙ্গে পথ হেঁটে ফিরল তখন তার মনে হচ্ছিল সে যেন একটা নদীর ধার থেকে ফিরে এলোএকটা সময়ের নদী যেটা কেবল বহে যায়কখনো ফিরে আসেনা মোটেইসে যেন নদী তীরে বসে বসে নদীর কল্লোল শুনছিলসুবিমলের কথা শুনছিলসুবিমল পথ চলতে চলতে অনবরত কথা বলছিলকেবলই বলছিলবলছিল, সে টুকাইকে তাদের কাছে রাখতে চায়তার কথা শুনে হেনার বেশ নিশ্চিন্ত হবার কথা কিন্তু, তা কি সে হতে পারছে? এই চরাচরের সমস্ত আলো ছায়া তাকে যেন ক্রমাগত ঘুরিয়ে মারছেকেবলই ঘুরিয়ে মারছেহেনা কথাও স্থির হয়ে থাকতে পারছে নারণিতকেও তো সে কতো ভালোবাসতোএখনও কি বাসে না ?

হেনা নিজের আয়নার কাছে প্রশ্ন করেআয়না কি মিথ্যা বলে ? তা হলে ? রণিত কেন তাকে দূরে সরিয়ে দিলো? নাকি হেনা নিজেই দূরে সরে এলোরণিত কেমন বদলে গেলোএকদিন খুব মার খেলো হেনাসেদিন রনিতের চোখমুখ দেখে কেমন ভয় পেয়ে গেলো হেনাএকটা আশ্চর্য ভয়তার পর রোজ রোজ ভয়টুকাইয়ের জন্যে একটা খেলনা বন্দুক কিনে এনেছিল হেনাকিন্তু সেটা নিয়ে কেমন ছেলেমানুষের মতো খেলতে শুরু করল রণিত

হেনা যেন রোজ কানের কাছে শুনত—“পালাও হেনা, পালাওএকটা ফাঁকা মাঠের মধ্যে যেন হেনা একাসেই মাঠে একটি মরা আর শুকনো গাছগাছের অজস্র পাখিগুলো বন্দুকের শব্দে পালিয়ে যাচ্ছেউড়ে যাচ্ছেহেনা কোথায় উড়ে যাবে? গাছের শুষ্ক ডালপালা একশ হাত হয়ে তাকে গিলে নিতে আসছেহেনা দৌড়ায়সেই থেকে হেনা ছুটে বেড়ায়নিজের থেকেনিজের ভালবাসার থেকেএকদিন একটা ব্লেড নিয়ে রণিত বলেছিল—“এই হেনা, হেনা, আমার হাতটা কেটে দাও, দ্যাখো যুদ্ধের সৈনিকের গা থেকে কেমন রক্ত পড়ে! হেনা ভয় পায়সে পালাতে চায়রণিত তার চুলের মুঠি ধরে ফিস ফিস করে বলে—“ পালাও হেনা, হেনা মেরি জান, পুরানো মানেই মৃত তুমি!

এ সব দু এক মুহূর্তের প্যাশন রণিতেরপরোক্ষনেই সুস্থির হয়ে যায় সেহেনা ডাক্তারের কথা বলেছিলরণিত আবার রেগে গেছিল আমি কি পাগল? পাগলের  সাথে থেকো না তা হলে

হেনা আলো বন্ধ করে আয়নার সামনে বসে ছিলআয়নায় সে কি অন্ধকারের প্রেত দেখছিল ? একটা ছিন্ন ভিন্ন ভালোবাসার প্রেত সে দেখছিলতখনি শশুর-বাবার ফোন এলোহেনা অনেক্ষন কথা বললপ্রশান্তবাবু সব কথা বললেন, ডাঃ সোমের কথা বললেনশেষে অনেক আকুতি নিয়ে বললেন—“আসবে হেনা? একবার আসবে ?”

হেনা ফোনটা হাতে নিয়ে বসে থাকল চারপাশে তার যেন অঝোর বৃষ্টি ঝরছেবৃষ্টির ভিতরে বৃষ্টি, তার ভিতরে আবার বৃষ্টিতার ভিতর একাধিক বৃষ্টির স্তররণিতের ফোন সুইচ অন করে দিয়েছে প্রশান্তবাবু, হেনা যেন ফোন করেহেনা তাই ফোন হাতে নিয়ে বসে আছেএক রকম অনন্তকাল বসে থাকার মতো তার ভঙ্গিকিন্তু হেনা বুঝে উঠতে পারছে না, সে কি করবে? সে কি করবে ? সুবিমলের তিনবার ফোন এলোহেনা ফোন ধরল নাসুবিমলের ডাক সে শুনতে পাচ্ছিল না

এই রকম কম বেশী অনন্ত, প্রায় সকল মানুষকে অধিকার করে থাকেসেই অধিকারের ভিতর মানুষ কোনো কূল কিনারা পায় নাতখন কি মানুষকে ব্যাধের মতো মনে হয় না! সে বুনো হাসের পিছনে ছুটে বেড়ায়বেড়াতে বেড়াতে সে গ্রাম, শহর, রাজনীতি সকলের সামনেই একবার করে থমকে দাঁড়ায়কিন্তু ভিন্ন সময়ে তার দাঁড়াবার ভঙ্গি ভিন্নসেই নিশ্চিত ভঙ্গিকে সে অস্বীকার করে একটা মাঠে গিয়ে দাঁড়ায়মাঠে মানুষ নেই, গাছপালা নেই, কেবল ছায়াছায়া আর বৃষ্টিকিংবা হেমন্তের মাঠে বৃষ্টি নেইঅথবা আছেহেনা ঠিক জানে নারণিতের গলা ফোনের ভিতর শূন্য মাঠে বাতাসের ফিস ফিসের মতো শুনছে হেনারণিত কিন্তু বৃষ্টির কথা বলছেহেনা দেখছে সেও বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছেহেনার চোখ ঝাপসাসে কিছু দেখতে পাচ্ছে নাবৃষ্টির শব্দে সে কিছু শুনতেও পাচ্ছে নাতার অনন্ত সত্ত্বার ভিতর শুধু সিক্ত এবং রোমাঞ্চিত এক আবেগ অপেক্ষা করে




কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.