অতিক্রম / অবিন সেন
এক
‘একদিন
সাহস করে আকাশ হয়ে যাব, ছাদ
থেকে টুক করে লাফিয়ে পড়ব, চিৎকার
করে দু-হাত মেলে দিয়ে বলল—আমি মেঘ, আমি মেঘ, বিদ্যুৎ মাখা মেঘ’ তারপর হি হি করে হাসি । টুকাই
ট্রেনের জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ধরতে ধরতে তার
কেন যে এ কথা মনে এলো, তা
সেই জানে!
টুকাইয়ের
মনোজগতে প্রবেশ করার সাধ্য রণিতের নেই, তথাপি সে মাঝে মাঝে এমন বর্ণহীন দেওয়ালের মতো হয়ে যায়, নিঝুম হয়ে যায় যে, মনে হয় এ মন তলহীন—টুপ
করে এক ফোঁটা বৃষ্টির আঘাতে ক্ষীণ তরঙ্গের হিল্লোলে মূর্ত হয়ে হাসির মতো ভঙ্গিমায়
মিলিয়ে যায় সহসা। তার পর থেকে সেই যে মুখে কুলুপ এঁটে গুম হয়ে
থাকে তা সারাদিন চলে, সে
বন্ধ তালা খোলার সাধ্য কারো নেই।
সেদিন মাঠে
অনেক অঢেল রোদ্দুর, যদিও
পড়ন্ত বিকেল, এই বিকেলে
খালি পায়ে মাঠে হাঁটলে মনে হয়—পতঙ্গদেরও সাহচর্য আছে, সে বড় অনুপম—বিকেলে
ক্লান্ত ঘাসের গন্ধের সঙ্গে মিশে থাকে ফড়িঙের ডানার সঞ্চার—সে তো ফ্রিজের ঠাণ্ডা পেঁয়াজের কলি
নয়—সে ভাপ দ্যায়, ধান খেতের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যেমন মনে হয় মাঠের থেকে
অদৃশ্য এক ভাপ—এক সাহচর্য উঠে এসে যেন টুকাই ও রণিতের সঙ্গে
পথ হাঁটে।
এই ভাপের
পৃথিবী টুকাইও জানে। সে বাবার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে একা একা
অনেক দৌড়ল মাঠের আল পথে। সন্ধেবেলা
ঘরে ফিরতে টুকাইয়ের গায়ে সেই সতেজ মাঠের গন্ধটা পাচ্ছিল না রণিত। সে এক
অদ্ভুত গন্ধ টুকাইয়ের কথার সঙ্গে হাসির সঙ্গে তার সারা স্বত্বা থেকে বাষ্পের মতো
উঠে আসে। সেটা না পেলেই রণিত বুঝতে পারে, ছেলের মন ভালো নেই। বাপ
ছেলের সে এক আশ্চর্য communication.
অথচ টুকাইয়ের
ভালো লাগবে ভেবেই রণিতের এই গ্রামের বাড়িতে আসা। বাড়িটা
রণিতের ঠাকুরদা বানিয়েছিলেন। দো-তলা, বাড়িটার চেহারা বিশাল। প্রাচীর
ঘেরা বিশাল উঠোন। ছেলেবেলায় সেখানে ভাইবোনেরা মিলে ক্রিকেট খেলত
রণিত। এখন তার বাবা মা শুধু বুক আগলে পড়ে আছে এই
পুরানো বাড়িতে। আর রণিতের ছোট কাকা। অবিবাহিত। তার
মেজ কাকা দিল্লীতে। বহুকাল হল তাদের শিকড় উপড়ে গিয়েছে। রণিত
আর তার দাদা রজত পালা করে বাবা মা’র কাছে আসে। এসে
কয়েকদিন করে থেকে যায়। হেনার সঙ্গে রণিতের ছাড়া ছাড়ি হয়ে
যাবার পরে টুকাইকে নিয়ে সে প্রায়ই আসে গ্রামের বাড়িতে। টুকাইয়ের
গাছপালা ভালো লাগে। সবুজ ভালো লাগে। রণিতেরও
আজ-কাল কলকাতায় দম বন্ধ হয়ে আসে। কেন তা সে বুঝতে পারে না। তার
কি মন খারাপ ? অথচ একটা ভীষণ
রাগে সে নিজেই হেনাকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছিল। কিন্তু
সেই চণ্ডাল রাগের উপর রনিতের কোন লাগাম নেই। অসহ্য চীৎকার
করে করে রণিতের বলতে ইচ্ছা করে “নেই” “নেই” “না, আমার লাগাম নেই”। তথাপি
কি মহৎ প্রেম, ভালোবাসার পরে
তাদের বিয়েটা হয়েছিল। তার আর হেনার। সেই
কলেজের বেলা থেকে আশ্চর্য মায়া আর ভালবাসায় হেনার স্বপ্নকে লালন করেছিল রণিত। তার
পর টুকাইয়ের জন্ম। অন্তহীন স্বপ্নের সব দিন। আর
এখন কি কেবল ঘৃণা ? না, না, রণিত যেন নিজের আয়নার সামনে থেকে সভয়ে সরে আসে—“না, না, ঘৃণা কেন হবে?” কিন্তু
রাগ, ভীষণ এক
রাগ...রাগের কথা ভাবতে ভাবতে রনিতের ক্লান্তি আসে। হেনাকে
দূরে সরিয়ে দেবার ক্লান্তি।
গ্রামের
বাড়িতে রেগুলার লোডশেডিং হয় বলে রণিত গত বছর একটা Inverter লাগিয়ে
দিয়েছে। কিন্তু টুকাই মাঝে মাঝে বায়না করে হ্যারিকেনের
আলোর জন্য। হ্যারিকেনের আলো জ্বেলে টুকাই বিছানায় বসে ছিল। দেওয়ালে
তার দীর্ঘ ছায়াটা দেখছিল রণিত। সেই দীর্ঘ ছায়া দেখে রণিতের মনে
হচ্ছিল টুকাই যেন কি বিশাল বড় হয়ে গিয়েছে। তার মাথা যেন
ঘরের ছাদে ঠেকে গিয়েছে। রণিত বলল
টুকাই তোমার
আকাশ হতে ইচ্ছা করে? ট্রেনে
আসতে আসতে বলছিলে ?
টুকাই জানালার
কাছে গিয়ে কান খাড়া করে ঝিঁঝিঁর ডাক শুনছিল। রণিতের কথা সে
শুনল কিনা সেই জানে। কিন্তু সে ঘাড় ফেরাতে তার চোখে
ওপচানো কৌতূহল দেখল রণিত, তার
পর সে ঘাড় ফিরিয়ে নেয়। ধীরে ধীরে বলে
বৃষ্টি হতে।
তার কথা ক্ষীণ
ফিস ফিসের মতো করে শোনায়, তার
বলার অভিলাষ অন্ধকারের ভিতর হাত পা মেলে যেন অনেকক্ষণ ভাসে, ভেসে ভেসে রণিতকে মাঝখানে রেখে
ঘুরপাক খায়, তখনি একটা
চামচিকে কোথা থেকে উড়ে এসে ঘরময় চরকি-পাক খেতে থাকে। টুকাই
চমকায়। ভয় পায়। লাফিয়ে সে
রণিতের কোলের কাছে সরে আসে, তার
ভয় বিহ্বল স্বর রণিতের কানের কাছে ভরসা চেয়ে ফিস ফিস—“বাবা” । রণিত একহাতে
টুকাইকে জড়িয়ে নিয়ে উষ্ণতার অভয় দিতে দিতে দ্যাখে চামচিকেটা তাকে ভেংচি দিতে দিতে
জানালা গলে বাইরের অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে।
টুকাই বললে না
তো কেন বৃষ্টি হতে চাও?
বৃষ্টি হয়ে
মাকে আর তমাকে ভিজিয়ে দেবো।
টুকাই খুব
ধীরে ধীরে কথা গুলো বলে—কেটে কেটে, যেন হাতে করে একটার পরে একটা কথা
সাজায় সে!
তার কথায় রণিত
যেন থমকে যায়। রণিতের চোখের সামনে তার নিজেরই শ্বাসপ্রশ্বাস
গুলো সমানে বুদবুদের মতো ভাসতে থাকে, ভেসে ভেসে একের পর এক ফেটে যেতে থাকে।
টুকাই নড়ে চড়ে
সোজা হয়ে বসে। বাবাকে দেখে।
বাবা মা কে
একটা ফোন করব?
সে অনুমতির
অপেক্ষায় রণিতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে—তার চোখ ম্লান
আলোর মতো নিভু নিভু হয়ে থকে।রণিত তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে
থাকতে বুঝতে পারে তার নিষ্প্রাণ হাত মোবাইল ফোনটা টুকাইয়ের দিকে এগিয়ে দেয়। যেন
রণিত নয়। রণিতের হাত। এ
ছাড়া রণিতের হাতের যেন কোন উপায় থাকে না।
টুকাই ফোন
নিয়ে জানালার কাছে সরে যায়—ফোনকে আদর করার মতো করে একটু হাত
বুলিয়ে নেয়। রণিত তার আদরের ভঙ্গি দেখতে পায়। একটা
ধুপের ধোঁয়ার মতো সুবাসের সেই ভঙ্গি—অন্ধকারে। আর
সেই সুবাস যেন বদলে গিয়ে অন্ধকারে কাচের গুঁড়োর মতো রণিতের সারা গায়ে বিঁধে যেতে
থাকে। সে অসহায়ের মতো দেখতে পায় টুকাই গুন গুন করে
কথা বলে, কিন্তু তার
কথার প্রতিটা পুঙটি রণিতের মনে হয় কাচখন্ড। রণিতের হাঁক
দিয়ে বলতে ইচ্ছা করে
টুকাই কাচখন্ড
ছড়িও না।
অন্ধকার যেন
রণিতের গলার স্বর শুষে নেয়। তাই টুকাই সে কথা শুনতে পায় না।
রণিত অসহায়ের
মতো বসে থাকে।
দুই
স্কুল থেকে
ফিরে বাগানে ছোট ছোট গাছগুলিতে জল দিচ্ছিল হেনা। দিতে
দিতে তার কেমন এক আবেগ লাগছিল । স্কুলে পর পর ছটা ক্লাস নিয়ে যে
ক্লান্তিটা মাথার ভিতর জমা হয়েছিলো সেটা যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছিল। মনে
হচ্ছিল তার চারদিকে যেন রঙের বুদ বুদ ভাসে, ভেসে ভেসে তারা তার চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে—তাদের
অপরূপ রঙের বাহার যেন অন্তহীন এক টান, তারা তাকে টানছিল, চারপাশ থেকে টানতে টানতে তারা তার আবেগ গুলকে ভেঙ্গে
ছত্রখান করছিল। হেনা সেই টানের গোলোক ধাঁধার ভিতর পথভ্রষ্ট হয়ে
বিমূড়, তার হাতের
ঝারি হাতেই অহেতুক রহে গেলো, তার
পিছনে সূর্যাস্ত—ক্যানভাস, বিকেল। সে কি
স্কুলে মীরাদির বলা কথাগুলো ভাবছিল? মিরাদি বলছিল—
‘সুবিমল, বেশ ভাল ছেলে, উদার; তুই কতদিন আর সেই পুরানো
ভাঙ্গাচোরা স্বপ্নের ভুত কোলে করে বসে থাকবি!’
বিকেলের এই ফাগুনের
আলো মাথার কাছে নিয়ে হেনা সুবিমলের কথা ভাবতে বসল, তার কি মাথা খারাপ হল ? কিংবা সেই সব রঙ্গিন বুদবুদ তাকে এক চক্রব্যূহের ভিতর
অহেতুক ঘুরিয়ে মারছিল, তা সে
ঠিক বুঝতে পারছিল না! বা অকারণ কোনো বসন্ত ঋতু তাকে উত্তেজিত করছিল। কিন্তু
তখনি টুকাইয়ের মুখখানি তার চোখের সামনে ভেসে উঠে। এমনি
করেই পৃথিবীর যাবতীয় চঞ্চলতা আলো আর অন্ধকারের রেণুর মতো নশ্বর জীবনের চারপাশে
আবর্তিত হয়। হেনা সেই আবর্তনের ভিতর দিশা-হীন। তার
আর কিছু ভাল লাগছিলো না। কতদিন সে টুকাইকে দ্যাখেনি। গতকাল
টুকাই ফোন করেছিল। টুকাই কি বলছিল হেনা তা ভাল করে
বুঝতে পারছিল না। টুকাই বৃষ্টির কথা বলছিল। বৃষ্টিতে
ভিজে যাওয়ার কথা বলছিল। বলছিল—‘মা, তুমি আর বাবা কবে ভিজবে বৃষ্টিতে ? একসাথে? আমিও তবে ভিজব!’
হেনা ঠিক
বুঝতে পারছিল না, টুকাই
কি তবে সময়ের থেকে অনেক বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে ? বড়ো হয়ে আর দৌড়ে সে কি তবে তাকে আর রণিতকে হারিয়ে দেবে ? হেনার কি এই হেরে যাওয়া ভালো
লাগবে ? হেনা ঠিক বুঝে
উঠতে পারছিল না।
হেনা আর
রণিতের বিয়েটা একটা ভুল বিয়ে বলে মনে করে হেনা। ভুল ? নিশ্চয়ই ভুল, হেনা নিজের মনের কাছে, আয়নার কাছে কনফেস করতে আর অলীক
হচ্ছে না এখন । তা হলে বিবাহের এতগুল বছর কি অলীক ? টুকাইয়ের জন্ম, আদরে আবদারে এতোগুলো বছর, সবি কি শীতের রুক্ষ প্রান্তরের
মতো কেবল শূন্যের দিকে অন্তহীন? হেনা
ভাবতে ভাবতে ভণ্ডুল হয়ে যায়। তার মাথার ভিতরটা শালিকের ঝরে পড়া
পালকের মতো বয়স্ক মনে হয়। সে তখন তার খেলা আর নানা রঙের
বুদবুদগুলির কাছে ফিরে আসে। তা ছাড়া তার উপায় কি ? টুকাইয়ের স্নেহ মমতা ভিন্ন তার
জীবনের সচ্ছলতা কি ? সুবিমল
কি তার সমস্ত খেয়ালের বুদবুদ গুলি হাতে তুলে নেবার জন্যে অপেক্ষায় আছে ?
মা, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকছিল হেনাকে। হেনা
বাগান থেকে শুনতে পাচ্ছিল। হেনা বুঝল সুবিমল এসেছে। সুবিমল
এলে মা এভাবেই উত্তেজিত হয়ে ডাকে। যেন হেনা এখুনি দৌড়ে আর হাঁপিয়ে
হাঁপিয়ে না পৌঁছালে বসন্তের সমস্ত দরজা জানালা গুলি বন্ধ হয়ে যাবে। মার
কাণ্ড দেখলে হেনার হাসি পায়, রাগ
হয়। হেনা কি পসরার মতো নিজেকে সাজিয়ে তুলবে সুবিমলের সামনে? হেনার মনে পড়ে, এক কালে রণিতও যখন আসত তখনও মা
এমনটাই করত। রণিত এখন ছায়ার দিকে সরে গেছে।
হেনা দেরি
করছিল। তার দেরি করতে ইচ্ছা করছিল। তার
নিজের ঘরে যাবার সময় উঁকি দিয়ে দেখল সুবিমল বসার ঘরে একটা সোফায় পায়ের উপর পা দিয়ে
বসে আছে। একটা পত্রিকার পাতা ওলটাচ্ছিল। বড্ড
অহঙ্কার তার ভঙ্গি। অহঙ্কার দিয়ে সে যেন সকলকে চমকে
দিতে চায়। হেনা নিজের ঘরে গিয়ে নাইটি বদলে নিয়ে একটা ছাপা
শাড়ি পড়ল। শাদা খোলের উপর হলুদ ফুল ফুল প্রিন্ট। পাড়ের
দিকে অল্প একটু সবুজের ছোঁওয়া। নিইটি পরে সে কখনো সুবিমলের সামনে
যায় না। নাইটিতো কেবল ঘরের মানুষের সামনে পরার জন্যে। সুবিমল
এখনও হেনার ঘরে-বাইরের দূরত্বে বসে আছে। হেনা চুলটা
একটা কাঁটা ক্লিপ দিয়ে পিছনদিকে চুড়ো করে নিলো। আয়নায়
নিজেকে দেখতে দেখতে আঁচল দিয়ে মুখটা একবার মুছে নিলো।
বসার ঘরে গিয়ে
দেখল মা সুবিমলের সঙ্গে গল্প করছে। হেনা ঘরে যেতে মা উৎসুক হয়ে বলল-
এতক্ষণ কোথায়
ছিলি রে ? সুবিমল কতক্ষণ
বসে আছে।
মা ঘরে আলো
জ্বেলে দিয়েছে। সুবিমল সেই উজ্জ্বল আলোয় হেনাকে দেখছিল।
হেনা মৃদু
হাসিতে তাকে অভ্যর্থনা করল।
হেনা আর
সুবিমল যে কথাগুলো বলছিল সে কথাগুলোর কনও উদ্দেশ্য থেকে না, সে গুলো কেবলই অকারণ হাওয়ায় ভেসে
ভেসে বেড়াবার মতো। যেন চারিদিকে শিমুলের তুলো উড়ে বেড়ায়
চৈত্রের শেষ বাতাসে। হেনা সেই হালকা ভারহীন তুলো কিছু
ধরে নিচ্ছে। সুবিমল কিছু ধরে নিয়ে তার পকেটে রেখে দিছে। কিংবা
কোনও পঠিত পত্রিকার ভিতর সে সেই সব মৃত তুলোর আঁশ গুলিকে জমিয়ে রাখছে। এখন
তারা মৃত। একদিন তারা রঙ আর আলোয় আন্দোলিত হত। এখন
তারা কেবল জমে থাকা ফসিলের মতো অনর্গল কথার ভিতর অন্তরীন হয়ে আছে।
সুবিমল
নিশ্চিত কিছু শুনতে চাইছিল, হেনার
কাছে।
শরতের
প্রান্তরে অঢেল ধানক্ষেতের মতো, নিশ্চিত।
কিন্তু হেনার
ভিতর কনও নিশ্চয়তা অবশিষ্ট নেই। সে ফাগুনের হাওয়ার মতো অস্থির। টুকাই
তাকে গতকাল বৃষ্টির কথা বলছিল। হেনার ভিতর যেন বৃষ্টির ধারা অঝর
ভাবে ঝরছিল। ঝরছিল এবং ঝরছিল। হেনা
সুস্থির হয়ে বসে থাকতে পারছিল না। সে বলল
সুবিমল, ঘরের ভিতর যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। চলো
কোথাও ঘুরে আসি।
কোথায় যাবে ?
যেখানে নিয়ে
যাবে...
হেনা অদ্ভুত
হেসে বলল।
সিনেমা যাবে ?
না, না, সিনেমায় আরো দম বন্ধ হয়ে যাবে। চলো
রাস্তায় হাঁটি।
তিন
মা’র
সঙ্গে কথা বলার পর টুকাইয়ের মন পাখির মতো হালকা লাগছিল। সে
দেওয়ালে লগ্ন তার বৃহৎ ছায়াগুলি দেখছিল, দেওয়ালের সামনে সে হাত পা নাড়ছিল। ছায়ারাও
হাত পা নাড়ছিল। টুকাই ছায়ার ভিতর—খেলার
ভিতর মগ্ন হয়ে যাচ্ছিল। রণিত এই সব দেখছিল। টুকাইয়ের
খেলার ভঙ্গি সে দেখছিল। এই সব ভঙ্গি তার চেনা । টুকাই
যেন তার সমস্ত চেনা আয়না-গুলর সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে আবিষ্কার করছিল। তার
সেই আবিষ্কার ভোরের বেলা পাখিদের খেলার মতো। মাঠ আর মাঠ
সংলগ্ন গাছে গাছে যেমন পাখিরা খেলে বেড়ায়। তাদের খুশির
ডানা সঞ্চার বাতাসের গায়ে আবেগ তৈরি করে, আবেগের বুদবুদ—বুদবুদের গায়ে
আলোর রামধনু হেসে হেসে যেন হেমন্তের সকালকে সচ্ছলতা দ্যায়। টুকাইকে
দেখে তেমনি মনে হচ্ছিল। রণিত যেন টুকাইয়ের ভিতর থেকে সেই
সব খেলার সুবাস পাচ্ছিল। সেই সুবাস সমস্ত ঘরে ভরে যায়।
টুকাই দৌড়ে
খেলনা রাখার তাকের কাছে গেলো। একটা খেলনা বন্দুক সে নিয়ে এলো। তারপর
সে দেওয়ালে লগ্ন ছায়ার দিকে তাক করে ফায়ার করে দিলো, দিয়েই সে বিছানায় হেলে গড়িয়ে পড়ল। ছায়ারাও
গড়িয়ে পড়ল। একি টুকাইয়ের খেলা না খেলার অভিনয়?
রণিতের ইচ্ছা
করছিল টুকাইয়ের সঙ্গে খেলতে। কিন্তু খেলার অভিনয় সে ছুতে
পারছিল না। সে একটা অস্থিরতার মধ্যে বসেছিল। খেলবে
কি, খেলবে না! এই
দ্বিধা বিভক্ত অনুভব নিয়ে সে বসেছিল। ভাবছিল। হেনার
কথাও সে ভাবছিল। ভাবতে ভাবতে এখন এই মুহূর্তে তার কোনো রাগ
হচ্ছিল না। টুকাইয়ের খুশির সুবাসের মধ্যে কি তার সমস্ত রাগ
দ্রবীভূত হয়ে যাচ্ছিল? তা
ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না রণিত। তার কি কনও অপরাধ বোধ জাগছিল মনে ? সে যে টুকাইকে হেনার মায়া মমতার
বৃন্ত থেকে উপড়ে নিয়ে চলে এসেছে তার কি অখুশি অনুভব টুকাইয়ের, তাকে কি এক প্রকার ক্লান্ত
অপরাধের ভিতর বন্ধ করছিল ? রণিত
তা বুঝে উঠতে চেষ্টা করেনি কখনো। তাকে কেবলই হেনার প্রতি এক গভীর
অভিমান অন্তরিন করে রেখেছে। আর তো কয়েক মাস পরেই লেখা পড়া করে
তাদের ছাড়া ছাড়ি হয়ে যাবে। তখন তো হেনার মুক্তি। ভাবতে
ভাবতেই রণিতের ভিতর সেই গভীর গভীরতর রাগ আবার জন্ম নেয়, বলা ভালো ভেসে ওঠে, ভেসে উঠে যেন যুদ্ধের মতো পল্টন
সাজায় সেই চণ্ডাল রাগ। তার ইচ্ছা করছিল সে টুকাইকে এমন
কথাও লুকিয়ে রাখবে যাতে হেনা কখনো খুঁজে না পায়! কিন্তু পরোক্ষনেই সে মুষড়ে পড়ে। কারণ
টুকাই! টুকাইয়ের উপর কি তবে অবিচার হবে না?
হটাত টুকাই
তাকে ডাকল
বাবা কি ভাবছ ? খেলবে না ?
খেলব বাবা।
তবে বন্দুক
নাও।
রণিত বন্দুক
নিলো। নিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে সে টুকাইয়ের দিকে তাকাল।টুকাইয়ের
খেলাটা সে বুঝতে পারছিল না।
বাবা, ওই অন্ধকার ছায়াগুলোকে গুলি করে
দাও।
বলে সে বন্দুক
তাক করার ভঙ্গি করে দেখাল। যেন সে জেনারেল টুকাই, গলা তুলে চিৎকার করে বলল—ফায়ার!
রণিত এবার
খেলাটা বুঝতে পারল। সে বন্দুকের ট্রিগারে চাপ দিল। শব্দ
ওলা বন্দুক ঘড় ঘড় করে শব্দ করল।
রণিতের মনে হল
চারিদিক থেকে যেন এক ঝাঁক পাখি উড়ে গেলো। পাখিরা সব
ছায়ার থেকে আলোর দিয়ে উড়ে যায় যেন। টুকাই হাত তালি দ্যায়। সে
আবার জেনারেলের মতো ফায়ার করার হুকুম করে।
রণিতেরও খুব
আমোদ লাগছিল। সে যেন ছেলেবেলার অভিনয়ে মেতে উঠেছে। তার
দুটো মোবাইল ফোন সে বন্ধ করে রেখেছে। সে যেন সভ্যতার যাবতীয় যোগাযোগের
অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছে। অফিস থেকেও সে ছুটি নিয়ে নিয়েছে। এখন
শুধু খেলা, কেবল খেলা। রণিতের
পৃথিবীও এখন খেলার পৃথিবী। টুকাইয়ের মতো।
রণিতের বাবা
প্রশান্তবাবু রণিতের এই পরিবর্তন লক্ষ করছিল। রণিত
প্রায় সপ্তাহ অধিক ছুটি নিয়ে বসে আছে। রণিত এতো দিন
কেন ছুটি নিয়ে বসে আছে ? কোনো
কিছু গোলমাল কি ? তাঁর
ভাবনা হয়। তা ছাড়া রণিতের মা’ও
বলছিল রণিতের চোখ মুখ যেন বদলে গিয়েছে। রণিত যেন সেই
আগের উচ্ছল স্বাভাবিক রণিতের ছায়া, কিংবা
এক অন্ধকার ছায়ার নীচে যেন রণিত চাপা পড়ে গিয়েছে। বুড়ো
বয়সে সন্তানের ভাবনায় বাবা মা যেন শতখন্ড হয়ে যাচ্ছে। সেভেনটি
আপ বয়সেও প্রশান্তবাবু বেশ শক্ত পোক্ত আছেন। রোজ সকালে এক
ঘণ্টা হাঁটেন, বাগানের
পরিচর্যা করেন। কিন্তু রণিতের নিয়ে ভাবনা তাকে টুকরো টুকরো করে
ফেলছে আজকাল। বৃদ্ধ বয়েসে একটা অন্ধকার ছায়া যেন তাঁদের ঢেকে
ফেলছে। হেমন্তের সন্ধ্যার মতো দুঃখী করে রেখেছে তাঁদের। প্রথম
ধাক্কা ছিলো হেনার সঙ্গে রণিতের বিচ্ছেদ। হেনা তো কতো
মায়া মমতায় ভরা মেয়ে ছিল। সে বৌমা নয়, মেয়েই ছিল যেন তাঁদের কাছে। কিন্তু
কি হয়ে গেলো, বা কেন এমন হল
এটা নিয়ে অন্ধকারেই আছে প্রশান্তবাবু। রণিত ও কিছু
বলল না। হেনাও কান্না কাটি করল একদিন ফোন করে, কিন্তু স্পষ্ট করে কিছু বলল না। সে
চলে গেলো বাড়ি ছেড়ে। এখন তাঁরা শুনছেন পাকা পাকি ভাবেই
এবার ছাড়া ছাড়ি হয়ে যাবে ওদের। টুকাইয়ের কথা কি কেউ ভাবল না ?
রণিত যখন
টুকাইয়ের সঙ্গে খেলছিল তখন প্রশান্তবাবু এলেন রণিতের ঘরে।
রণিত তোর
অফিসের ছুটি ক’দিনের ?
রণিত প্রথমটায়
যেন শুনতে পায়নি। প্রশান্তবাবু আবার ডাকতে সে চোখ তুলে তাকাল। যেন
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল।
ছুটি ?
সে যেন
প্রশ্নটা বুঝে উঠতে পারছে না।
ক’দিনের
ছুটি নিয়েছিস রে ?
বাবা, এখন তো ছুটি! খেলছি দেখছ না !
প্রশান্তবাবু
একটা চেয়ারে বসলেন।
কি খেলছিস ?
রণিত প্রশ্নটা
শুনে টুকাইয়ের দিকে তাকাল।
কি খেলা খেলছি
বলতো টুকাই ?
যুদ্ধ যুদ্ধ
খেলা।
রণিত আবার
প্রশান্ত বাবুর দিকে ফিরল, বন্দুক
তাক করল
যুদ্ধ!
বলেই ঘড় ঘড়
করে বন্দুক চালিয়ে দিলো।
রণিত, হেনাকে ডাকবে না এই খেলায় ?
হেনা?
রণিত আবার
শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল। যেন সে একটা ভাঙ্গা চোরা সমাধি
ফলকের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা মৃত সম্পর্কের সমাধি। সে আর
মৃত কোনো কিছু আস্ত রাখবে না, সব সে
বন্দুকের গুলিতে ভেঙ্গে উড়িয়ে দেবে। হেনাকে কি সে মনে করতে পারছে না ? নাকি হেনা পুরানো হয়ে গিয়েছে তার
কাছে! যেকোনো পুরানো কিছুই মৃত রণিতের কাছে। সে সব নতুন
করে চায়। হেনাও তো পুরানো।
প্রশান্তবাবু
আবার প্রশ্নটা করলেন
রণিত, হেনাকে নিয়ে খেলবে না ?
না, না, হেনাতো বড় হয়ে গিয়েছে, আর পুরানো, সে
খেলতে পারবে ?
রণিতের যেন
ভীষণ সন্দেহ হয়।
প্রশান্তবাবু
অতিস কে ডেকেছিলেন। তাঁর বন্ধু, ডাঃ অতিস সোম, পণ্ডিত মানুষ। ডাঃ
সোম বাইরে থেকে ডাক দিলেন
প্রশান্ত কোথয়?
প্রশান্তবাবু
তাঁকে নিয়ে এসে আর একটা চেয়ারে বসতে দিলেন ।
রণিত বাবা
কেমন আছো ?
রণিত ঘাড়
ফেরালো।
সোম কাকু কখন
এলেন ?
এই, তো। এ কি
কারেন্ট আছে তো, হ্যারিকেনের
আলোয় কি করছ ? প্রশান্ত
আলোটা জ্বেলে দাও ভাই !
প্রশান্ত
আলোটা জ্বেলে দিলেন।
রণিত সহসা
চমকে উঠল। ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল
বাবা, আলোটা নিভিয়ে দাও, নিভিয়ে দাও বলছি, আমি খেলছি !
ডাঃ সোম ইশারা
করলেন।
প্রশান্ত বাবু
আলোটা নিভিয়ে দিলেন আবার।
ডাঃ সোম গল্প
শুরু করলেন রণিতের সঙ্গে।
তারা টুক টুক
করে অনেক গল্প করলেন। যুদ্ধের কথা। খেলার
কথা। হেনার কথাও। রণিত বলল, হেনা পুরানো হয়ে গেছে।
রনিত আর টুকাই
আবার খেলতে থাকল।
প্রশান্তবাবু
আর ডাঃ সোম বেরিয়ে এলেন।
কি বুঝছ সোম ?
প্রশান্ত এ
একটা জটিল অবস্থা। রণিতের মাথার মধ্যে, একটা ওলটপালট ঘটে গেছে। কিন্তু
সেটা কেন হল সেটা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।
বৌমার সঙ্গে
বিচ্ছেদ এর জন্যে কি ?
না তা নয় মনে
হয়, এটার জন্যেই
বিচ্ছেদ।
বৌমাকে একবার
আনতে পারবি ? কথা বলব ।
চার
হেনা যখন সুবিমলের
সঙ্গে পথ হেঁটে ফিরল তখন তার মনে হচ্ছিল সে যেন একটা নদীর ধার থেকে ফিরে এলো। একটা
সময়ের নদী যেটা কেবল বহে যায়। কখনো ফিরে আসেনা মোটেই। সে
যেন নদী তীরে বসে বসে নদীর কল্লোল শুনছিল। সুবিমলের কথা
শুনছিল। সুবিমল পথ চলতে চলতে অনবরত কথা বলছিল। কেবলই
বলছিল। বলছিল, সে টুকাইকে তাদের কাছে রাখতে চায়। তার
কথা শুনে হেনার বেশ নিশ্চিন্ত হবার কথা কিন্তু, তা কি সে হতে পারছে? এই চরাচরের সমস্ত আলো ছায়া তাকে যেন ক্রমাগত ঘুরিয়ে মারছে। কেবলই
ঘুরিয়ে মারছে। হেনা কথাও স্থির হয়ে থাকতে পারছে না। রণিতকেও
তো সে কতো ভালোবাসতো। এখনও কি বাসে না ?
হেনা নিজের
আয়নার কাছে প্রশ্ন করে। আয়না কি মিথ্যা বলে ? তা হলে ? রণিত কেন তাকে দূরে সরিয়ে দিলো? নাকি হেনা নিজেই দূরে সরে এলো। রণিত
কেমন বদলে গেলো। একদিন খুব মার খেলো হেনা। সেদিন
রনিতের চোখমুখ দেখে কেমন ভয় পেয়ে গেলো হেনা। একটা আশ্চর্য
ভয়। তার পর রোজ রোজ ভয়। টুকাইয়ের
জন্যে একটা খেলনা বন্দুক কিনে এনেছিল হেনা। কিন্তু সেটা
নিয়ে কেমন ছেলেমানুষের মতো খেলতে শুরু করল রণিত।
হেনা যেন রোজ
কানের কাছে শুনত—“পালাও হেনা, পালাও”। একটা
ফাঁকা মাঠের মধ্যে যেন হেনা একা। সেই মাঠে একটি মরা আর শুকনো গাছ। গাছের
অজস্র পাখিগুলো বন্দুকের শব্দে পালিয়ে যাচ্ছে। উড়ে
যাচ্ছে। হেনা কোথায় উড়ে যাবে? গাছের শুষ্ক ডালপালা একশ হাত হয়ে
তাকে গিলে নিতে আসছে। হেনা দৌড়ায়। সেই
থেকে হেনা ছুটে বেড়ায়। নিজের থেকে। নিজের
ভালবাসার থেকে। একদিন একটা ব্লেড নিয়ে রণিত বলেছিল—“এই
হেনা, হেনা, আমার হাতটা কেটে দাও, দ্যাখো যুদ্ধের সৈনিকের গা থেকে
কেমন রক্ত পড়ে”! হেনা ভয় পায়। সে
পালাতে চায়। রণিত তার চুলের মুঠি ধরে ফিস ফিস করে বলে—“ পালাও হেনা, হেনা মেরি জান, পুরানো মানেই মৃত তুমি”!
এ সব দু এক
মুহূর্তের প্যাশন রণিতের। পরোক্ষনেই সুস্থির হয়ে যায় সে। হেনা
ডাক্তারের কথা বলেছিল। রণিত আবার রেগে গেছিল। “আমি কি পাগল? পাগলের সাথে থেকো না তা হলে”।
হেনা আলো বন্ধ
করে আয়নার সামনে বসে ছিল। আয়নায় সে কি অন্ধকারের প্রেত
দেখছিল ? একটা ছিন্ন
ভিন্ন ভালোবাসার প্রেত সে দেখছিল। তখনি শশুর-বাবার ফোন এলো। হেনা
অনেক্ষন কথা বলল। প্রশান্তবাবু সব কথা বললেন, ডাঃ সোমের কথা বললেন। শেষে
অনেক আকুতি নিয়ে বললেন—“আসবে হেনা? একবার আসবে ?”
হেনা ফোনটা
হাতে নিয়ে বসে থাকল । চারপাশে তার যেন অঝোর বৃষ্টি ঝরছে। বৃষ্টির
ভিতরে বৃষ্টি, তার ভিতরে
আবার বৃষ্টি। তার ভিতর একাধিক বৃষ্টির স্তর। রণিতের
ফোন সুইচ অন করে দিয়েছে প্রশান্তবাবু, হেনা যেন ফোন করে। হেনা তাই ফোন
হাতে নিয়ে বসে আছে। এক রকম অনন্তকাল বসে থাকার মতো
তার ভঙ্গি। কিন্তু হেনা বুঝে উঠতে পারছে না, সে কি করবে? সে কি করবে ? সুবিমলের তিনবার ফোন এলো। হেনা
ফোন ধরল না। সুবিমলের ডাক সে শুনতে পাচ্ছিল না।
এই রকম কম বেশী
অনন্ত, প্রায় সকল
মানুষকে অধিকার করে থাকে। সেই অধিকারের ভিতর মানুষ কোনো কূল
কিনারা পায় না। তখন কি মানুষকে ব্যাধের মতো মনে হয় না! সে বুনো
হাসের পিছনে ছুটে বেড়ায়। বেড়াতে বেড়াতে সে গ্রাম, শহর, রাজনীতি সকলের সামনেই একবার করে
থমকে দাঁড়ায়। কিন্তু ভিন্ন সময়ে তার দাঁড়াবার ভঙ্গি ভিন্ন। সেই
নিশ্চিত ভঙ্গিকে সে অস্বীকার করে একটা মাঠে গিয়ে দাঁড়ায়। মাঠে
মানুষ নেই, গাছপালা নেই, কেবল ছায়া। ছায়া
আর বৃষ্টি। কিংবা হেমন্তের মাঠে বৃষ্টি নেই। অথবা
আছে। হেনা ঠিক জানে না। রণিতের গলা
ফোনের ভিতর শূন্য মাঠে বাতাসের ফিস ফিসের মতো শুনছে হেনা। রণিত
কিন্তু বৃষ্টির কথা বলছে। হেনা দেখছে সেও বৃষ্টিতে ভিজে
যাচ্ছে। হেনার চোখ ঝাপসা। সে
কিছু দেখতে পাচ্ছে না। বৃষ্টির শব্দে সে কিছু শুনতেও
পাচ্ছে না। তার অনন্ত সত্ত্বার ভিতর শুধু সিক্ত এবং
রোমাঞ্চিত এক আবেগ অপেক্ষা করে।
‘একদিন
সাহস করে আকাশ হয়ে যাব, ছাদ
থেকে টুক করে লাফিয়ে পড়ব, চিৎকার
করে দু-হাত মেলে দিয়ে বলল—আমি মেঘ, আমি মেঘ, বিদ্যুৎ মাখা মেঘ’ তারপর হি হি করে হাসি । টুকাই
ট্রেনের জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ধরতে ধরতে তার
কেন যে এ কথা মনে এলো, তা
সেই জানে!
টুকাইয়ের
মনোজগতে প্রবেশ করার সাধ্য রণিতের নেই, তথাপি সে মাঝে মাঝে এমন বর্ণহীন দেওয়ালের মতো হয়ে যায়, নিঝুম হয়ে যায় যে, মনে হয় এ মন তলহীন—টুপ
করে এক ফোঁটা বৃষ্টির আঘাতে ক্ষীণ তরঙ্গের হিল্লোলে মূর্ত হয়ে হাসির মতো ভঙ্গিমায়
মিলিয়ে যায় সহসা। তার পর থেকে সেই যে মুখে কুলুপ এঁটে গুম হয়ে
থাকে তা সারাদিন চলে, সে
বন্ধ তালা খোলার সাধ্য কারো নেই।
সেদিন মাঠে
অনেক অঢেল রোদ্দুর, যদিও
পড়ন্ত বিকেল, এই বিকেলে
খালি পায়ে মাঠে হাঁটলে মনে হয়—পতঙ্গদেরও সাহচর্য আছে, সে বড় অনুপম—বিকেলে
ক্লান্ত ঘাসের গন্ধের সঙ্গে মিশে থাকে ফড়িঙের ডানার সঞ্চার—সে তো ফ্রিজের ঠাণ্ডা পেঁয়াজের কলি
নয়—সে ভাপ দ্যায়, ধান খেতের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যেমন মনে হয় মাঠের থেকে
অদৃশ্য এক ভাপ—এক সাহচর্য উঠে এসে যেন টুকাই ও রণিতের সঙ্গে
পথ হাঁটে।
এই ভাপের
পৃথিবী টুকাইও জানে। সে বাবার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে একা একা
অনেক দৌড়ল মাঠের আল পথে। সন্ধেবেলা
ঘরে ফিরতে টুকাইয়ের গায়ে সেই সতেজ মাঠের গন্ধটা পাচ্ছিল না রণিত। সে এক
অদ্ভুত গন্ধ টুকাইয়ের কথার সঙ্গে হাসির সঙ্গে তার সারা স্বত্বা থেকে বাষ্পের মতো
উঠে আসে। সেটা না পেলেই রণিত বুঝতে পারে, ছেলের মন ভালো নেই। বাপ
ছেলের সে এক আশ্চর্য communication.
অথচ টুকাইয়ের
ভালো লাগবে ভেবেই রণিতের এই গ্রামের বাড়িতে আসা। বাড়িটা
রণিতের ঠাকুরদা বানিয়েছিলেন। দো-তলা, বাড়িটার চেহারা বিশাল। প্রাচীর
ঘেরা বিশাল উঠোন। ছেলেবেলায় সেখানে ভাইবোনেরা মিলে ক্রিকেট খেলত
রণিত। এখন তার বাবা মা শুধু বুক আগলে পড়ে আছে এই
পুরানো বাড়িতে। আর রণিতের ছোট কাকা। অবিবাহিত। তার
মেজ কাকা দিল্লীতে। বহুকাল হল তাদের শিকড় উপড়ে গিয়েছে। রণিত
আর তার দাদা রজত পালা করে বাবা মা’র কাছে আসে। এসে
কয়েকদিন করে থেকে যায়। হেনার সঙ্গে রণিতের ছাড়া ছাড়ি হয়ে
যাবার পরে টুকাইকে নিয়ে সে প্রায়ই আসে গ্রামের বাড়িতে। টুকাইয়ের
গাছপালা ভালো লাগে। সবুজ ভালো লাগে। রণিতেরও
আজ-কাল কলকাতায় দম বন্ধ হয়ে আসে। কেন তা সে বুঝতে পারে না। তার
কি মন খারাপ ? অথচ একটা ভীষণ
রাগে সে নিজেই হেনাকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছিল। কিন্তু
সেই চণ্ডাল রাগের উপর রনিতের কোন লাগাম নেই। অসহ্য চীৎকার
করে করে রণিতের বলতে ইচ্ছা করে “নেই” “নেই” “না, আমার লাগাম নেই”। তথাপি
কি মহৎ প্রেম, ভালোবাসার পরে
তাদের বিয়েটা হয়েছিল। তার আর হেনার। সেই
কলেজের বেলা থেকে আশ্চর্য মায়া আর ভালবাসায় হেনার স্বপ্নকে লালন করেছিল রণিত। তার
পর টুকাইয়ের জন্ম। অন্তহীন স্বপ্নের সব দিন। আর
এখন কি কেবল ঘৃণা ? না, না, রণিত যেন নিজের আয়নার সামনে থেকে সভয়ে সরে আসে—“না, না, ঘৃণা কেন হবে?” কিন্তু
রাগ, ভীষণ এক
রাগ...রাগের কথা ভাবতে ভাবতে রনিতের ক্লান্তি আসে। হেনাকে
দূরে সরিয়ে দেবার ক্লান্তি।
গ্রামের
বাড়িতে রেগুলার লোডশেডিং হয় বলে রণিত গত বছর একটা Inverter লাগিয়ে
দিয়েছে। কিন্তু টুকাই মাঝে মাঝে বায়না করে হ্যারিকেনের
আলোর জন্য। হ্যারিকেনের আলো জ্বেলে টুকাই বিছানায় বসে ছিল। দেওয়ালে
তার দীর্ঘ ছায়াটা দেখছিল রণিত। সেই দীর্ঘ ছায়া দেখে রণিতের মনে
হচ্ছিল টুকাই যেন কি বিশাল বড় হয়ে গিয়েছে। তার মাথা যেন
ঘরের ছাদে ঠেকে গিয়েছে। রণিত বলল
টুকাই তোমার
আকাশ হতে ইচ্ছা করে? ট্রেনে
আসতে আসতে বলছিলে ?
টুকাই জানালার
কাছে গিয়ে কান খাড়া করে ঝিঁঝিঁর ডাক শুনছিল। রণিতের কথা সে
শুনল কিনা সেই জানে। কিন্তু সে ঘাড় ফেরাতে তার চোখে
ওপচানো কৌতূহল দেখল রণিত, তার
পর সে ঘাড় ফিরিয়ে নেয়। ধীরে ধীরে বলে
বৃষ্টি হতে।
তার কথা ক্ষীণ
ফিস ফিসের মতো করে শোনায়, তার
বলার অভিলাষ অন্ধকারের ভিতর হাত পা মেলে যেন অনেকক্ষণ ভাসে, ভেসে ভেসে রণিতকে মাঝখানে রেখে
ঘুরপাক খায়, তখনি একটা
চামচিকে কোথা থেকে উড়ে এসে ঘরময় চরকি-পাক খেতে থাকে। টুকাই
চমকায়। ভয় পায়। লাফিয়ে সে
রণিতের কোলের কাছে সরে আসে, তার
ভয় বিহ্বল স্বর রণিতের কানের কাছে ভরসা চেয়ে ফিস ফিস—“বাবা” । রণিত একহাতে
টুকাইকে জড়িয়ে নিয়ে উষ্ণতার অভয় দিতে দিতে দ্যাখে চামচিকেটা তাকে ভেংচি দিতে দিতে
জানালা গলে বাইরের অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে।
টুকাই বললে না
তো কেন বৃষ্টি হতে চাও?
বৃষ্টি হয়ে
মাকে আর তমাকে ভিজিয়ে দেবো।
টুকাই খুব
ধীরে ধীরে কথা গুলো বলে—কেটে কেটে, যেন হাতে করে একটার পরে একটা কথা
সাজায় সে!
তার কথায় রণিত
যেন থমকে যায়। রণিতের চোখের সামনে তার নিজেরই শ্বাসপ্রশ্বাস
গুলো সমানে বুদবুদের মতো ভাসতে থাকে, ভেসে ভেসে একের পর এক ফেটে যেতে থাকে।
টুকাই নড়ে চড়ে
সোজা হয়ে বসে। বাবাকে দেখে।
বাবা মা কে
একটা ফোন করব?
সে অনুমতির
অপেক্ষায় রণিতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে—তার চোখ ম্লান
আলোর মতো নিভু নিভু হয়ে থকে।রণিত তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে
থাকতে বুঝতে পারে তার নিষ্প্রাণ হাত মোবাইল ফোনটা টুকাইয়ের দিকে এগিয়ে দেয়। যেন
রণিত নয়। রণিতের হাত। এ
ছাড়া রণিতের হাতের যেন কোন উপায় থাকে না।
টুকাই ফোন
নিয়ে জানালার কাছে সরে যায়—ফোনকে আদর করার মতো করে একটু হাত
বুলিয়ে নেয়। রণিত তার আদরের ভঙ্গি দেখতে পায়। একটা
ধুপের ধোঁয়ার মতো সুবাসের সেই ভঙ্গি—অন্ধকারে। আর
সেই সুবাস যেন বদলে গিয়ে অন্ধকারে কাচের গুঁড়োর মতো রণিতের সারা গায়ে বিঁধে যেতে
থাকে। সে অসহায়ের মতো দেখতে পায় টুকাই গুন গুন করে
কথা বলে, কিন্তু তার
কথার প্রতিটা পুঙটি রণিতের মনে হয় কাচখন্ড। রণিতের হাঁক
দিয়ে বলতে ইচ্ছা করে
টুকাই কাচখন্ড
ছড়িও না।
অন্ধকার যেন
রণিতের গলার স্বর শুষে নেয়। তাই টুকাই সে কথা শুনতে পায় না।
রণিত অসহায়ের
মতো বসে থাকে।
দুই
স্কুল থেকে
ফিরে বাগানে ছোট ছোট গাছগুলিতে জল দিচ্ছিল হেনা। দিতে
দিতে তার কেমন এক আবেগ লাগছিল । স্কুলে পর পর ছটা ক্লাস নিয়ে যে
ক্লান্তিটা মাথার ভিতর জমা হয়েছিলো সেটা যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছিল। মনে
হচ্ছিল তার চারদিকে যেন রঙের বুদ বুদ ভাসে, ভেসে ভেসে তারা তার চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে—তাদের
অপরূপ রঙের বাহার যেন অন্তহীন এক টান, তারা তাকে টানছিল, চারপাশ থেকে টানতে টানতে তারা তার আবেগ গুলকে ভেঙ্গে
ছত্রখান করছিল। হেনা সেই টানের গোলোক ধাঁধার ভিতর পথভ্রষ্ট হয়ে
বিমূড়, তার হাতের
ঝারি হাতেই অহেতুক রহে গেলো, তার
পিছনে সূর্যাস্ত—ক্যানভাস, বিকেল। সে কি
স্কুলে মীরাদির বলা কথাগুলো ভাবছিল? মিরাদি বলছিল—
‘সুবিমল, বেশ ভাল ছেলে, উদার; তুই কতদিন আর সেই পুরানো
ভাঙ্গাচোরা স্বপ্নের ভুত কোলে করে বসে থাকবি!’
বিকেলের এই ফাগুনের
আলো মাথার কাছে নিয়ে হেনা সুবিমলের কথা ভাবতে বসল, তার কি মাথা খারাপ হল ? কিংবা সেই সব রঙ্গিন বুদবুদ তাকে এক চক্রব্যূহের ভিতর
অহেতুক ঘুরিয়ে মারছিল, তা সে
ঠিক বুঝতে পারছিল না! বা অকারণ কোনো বসন্ত ঋতু তাকে উত্তেজিত করছিল। কিন্তু
তখনি টুকাইয়ের মুখখানি তার চোখের সামনে ভেসে উঠে। এমনি
করেই পৃথিবীর যাবতীয় চঞ্চলতা আলো আর অন্ধকারের রেণুর মতো নশ্বর জীবনের চারপাশে
আবর্তিত হয়। হেনা সেই আবর্তনের ভিতর দিশা-হীন। তার
আর কিছু ভাল লাগছিলো না। কতদিন সে টুকাইকে দ্যাখেনি। গতকাল
টুকাই ফোন করেছিল। টুকাই কি বলছিল হেনা তা ভাল করে
বুঝতে পারছিল না। টুকাই বৃষ্টির কথা বলছিল। বৃষ্টিতে
ভিজে যাওয়ার কথা বলছিল। বলছিল—‘মা, তুমি আর বাবা কবে ভিজবে বৃষ্টিতে ? একসাথে? আমিও তবে ভিজব!’
হেনা ঠিক
বুঝতে পারছিল না, টুকাই
কি তবে সময়ের থেকে অনেক বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে ? বড়ো হয়ে আর দৌড়ে সে কি তবে তাকে আর রণিতকে হারিয়ে দেবে ? হেনার কি এই হেরে যাওয়া ভালো
লাগবে ? হেনা ঠিক বুঝে
উঠতে পারছিল না।
হেনা আর
রণিতের বিয়েটা একটা ভুল বিয়ে বলে মনে করে হেনা। ভুল ? নিশ্চয়ই ভুল, হেনা নিজের মনের কাছে, আয়নার কাছে কনফেস করতে আর অলীক
হচ্ছে না এখন । তা হলে বিবাহের এতগুল বছর কি অলীক ? টুকাইয়ের জন্ম, আদরে আবদারে এতোগুলো বছর, সবি কি শীতের রুক্ষ প্রান্তরের
মতো কেবল শূন্যের দিকে অন্তহীন? হেনা
ভাবতে ভাবতে ভণ্ডুল হয়ে যায়। তার মাথার ভিতরটা শালিকের ঝরে পড়া
পালকের মতো বয়স্ক মনে হয়। সে তখন তার খেলা আর নানা রঙের
বুদবুদগুলির কাছে ফিরে আসে। তা ছাড়া তার উপায় কি ? টুকাইয়ের স্নেহ মমতা ভিন্ন তার
জীবনের সচ্ছলতা কি ? সুবিমল
কি তার সমস্ত খেয়ালের বুদবুদ গুলি হাতে তুলে নেবার জন্যে অপেক্ষায় আছে ?
মা, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকছিল হেনাকে। হেনা
বাগান থেকে শুনতে পাচ্ছিল। হেনা বুঝল সুবিমল এসেছে। সুবিমল
এলে মা এভাবেই উত্তেজিত হয়ে ডাকে। যেন হেনা এখুনি দৌড়ে আর হাঁপিয়ে
হাঁপিয়ে না পৌঁছালে বসন্তের সমস্ত দরজা জানালা গুলি বন্ধ হয়ে যাবে। মার
কাণ্ড দেখলে হেনার হাসি পায়, রাগ
হয়। হেনা কি পসরার মতো নিজেকে সাজিয়ে তুলবে সুবিমলের সামনে? হেনার মনে পড়ে, এক কালে রণিতও যখন আসত তখনও মা
এমনটাই করত। রণিত এখন ছায়ার দিকে সরে গেছে।
হেনা দেরি
করছিল। তার দেরি করতে ইচ্ছা করছিল। তার
নিজের ঘরে যাবার সময় উঁকি দিয়ে দেখল সুবিমল বসার ঘরে একটা সোফায় পায়ের উপর পা দিয়ে
বসে আছে। একটা পত্রিকার পাতা ওলটাচ্ছিল। বড্ড
অহঙ্কার তার ভঙ্গি। অহঙ্কার দিয়ে সে যেন সকলকে চমকে
দিতে চায়। হেনা নিজের ঘরে গিয়ে নাইটি বদলে নিয়ে একটা ছাপা
শাড়ি পড়ল। শাদা খোলের উপর হলুদ ফুল ফুল প্রিন্ট। পাড়ের
দিকে অল্প একটু সবুজের ছোঁওয়া। নিইটি পরে সে কখনো সুবিমলের সামনে
যায় না। নাইটিতো কেবল ঘরের মানুষের সামনে পরার জন্যে। সুবিমল
এখনও হেনার ঘরে-বাইরের দূরত্বে বসে আছে। হেনা চুলটা
একটা কাঁটা ক্লিপ দিয়ে পিছনদিকে চুড়ো করে নিলো। আয়নায়
নিজেকে দেখতে দেখতে আঁচল দিয়ে মুখটা একবার মুছে নিলো।
বসার ঘরে গিয়ে
দেখল মা সুবিমলের সঙ্গে গল্প করছে। হেনা ঘরে যেতে মা উৎসুক হয়ে বলল-
এতক্ষণ কোথায়
ছিলি রে ? সুবিমল কতক্ষণ
বসে আছে।
মা ঘরে আলো
জ্বেলে দিয়েছে। সুবিমল সেই উজ্জ্বল আলোয় হেনাকে দেখছিল।
হেনা মৃদু
হাসিতে তাকে অভ্যর্থনা করল।
হেনা আর
সুবিমল যে কথাগুলো বলছিল সে কথাগুলোর কনও উদ্দেশ্য থেকে না, সে গুলো কেবলই অকারণ হাওয়ায় ভেসে
ভেসে বেড়াবার মতো। যেন চারিদিকে শিমুলের তুলো উড়ে বেড়ায়
চৈত্রের শেষ বাতাসে। হেনা সেই হালকা ভারহীন তুলো কিছু
ধরে নিচ্ছে। সুবিমল কিছু ধরে নিয়ে তার পকেটে রেখে দিছে। কিংবা
কোনও পঠিত পত্রিকার ভিতর সে সেই সব মৃত তুলোর আঁশ গুলিকে জমিয়ে রাখছে। এখন
তারা মৃত। একদিন তারা রঙ আর আলোয় আন্দোলিত হত। এখন
তারা কেবল জমে থাকা ফসিলের মতো অনর্গল কথার ভিতর অন্তরীন হয়ে আছে।
সুবিমল
নিশ্চিত কিছু শুনতে চাইছিল, হেনার
কাছে।
শরতের
প্রান্তরে অঢেল ধানক্ষেতের মতো, নিশ্চিত।
কিন্তু হেনার
ভিতর কনও নিশ্চয়তা অবশিষ্ট নেই। সে ফাগুনের হাওয়ার মতো অস্থির। টুকাই
তাকে গতকাল বৃষ্টির কথা বলছিল। হেনার ভিতর যেন বৃষ্টির ধারা অঝর
ভাবে ঝরছিল। ঝরছিল এবং ঝরছিল। হেনা
সুস্থির হয়ে বসে থাকতে পারছিল না। সে বলল
সুবিমল, ঘরের ভিতর যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। চলো
কোথাও ঘুরে আসি।
কোথায় যাবে ?
যেখানে নিয়ে
যাবে...
হেনা অদ্ভুত
হেসে বলল।
সিনেমা যাবে ?
না, না, সিনেমায় আরো দম বন্ধ হয়ে যাবে। চলো
রাস্তায় হাঁটি।
তিন
মা’র
সঙ্গে কথা বলার পর টুকাইয়ের মন পাখির মতো হালকা লাগছিল। সে
দেওয়ালে লগ্ন তার বৃহৎ ছায়াগুলি দেখছিল, দেওয়ালের সামনে সে হাত পা নাড়ছিল। ছায়ারাও
হাত পা নাড়ছিল। টুকাই ছায়ার ভিতর—খেলার
ভিতর মগ্ন হয়ে যাচ্ছিল। রণিত এই সব দেখছিল। টুকাইয়ের
খেলার ভঙ্গি সে দেখছিল। এই সব ভঙ্গি তার চেনা । টুকাই
যেন তার সমস্ত চেনা আয়না-গুলর সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে আবিষ্কার করছিল। তার
সেই আবিষ্কার ভোরের বেলা পাখিদের খেলার মতো। মাঠ আর মাঠ
সংলগ্ন গাছে গাছে যেমন পাখিরা খেলে বেড়ায়। তাদের খুশির
ডানা সঞ্চার বাতাসের গায়ে আবেগ তৈরি করে, আবেগের বুদবুদ—বুদবুদের গায়ে
আলোর রামধনু হেসে হেসে যেন হেমন্তের সকালকে সচ্ছলতা দ্যায়। টুকাইকে
দেখে তেমনি মনে হচ্ছিল। রণিত যেন টুকাইয়ের ভিতর থেকে সেই
সব খেলার সুবাস পাচ্ছিল। সেই সুবাস সমস্ত ঘরে ভরে যায়।
টুকাই দৌড়ে
খেলনা রাখার তাকের কাছে গেলো। একটা খেলনা বন্দুক সে নিয়ে এলো। তারপর
সে দেওয়ালে লগ্ন ছায়ার দিকে তাক করে ফায়ার করে দিলো, দিয়েই সে বিছানায় হেলে গড়িয়ে পড়ল। ছায়ারাও
গড়িয়ে পড়ল। একি টুকাইয়ের খেলা না খেলার অভিনয়?
রণিতের ইচ্ছা
করছিল টুকাইয়ের সঙ্গে খেলতে। কিন্তু খেলার অভিনয় সে ছুতে
পারছিল না। সে একটা অস্থিরতার মধ্যে বসেছিল। খেলবে
কি, খেলবে না! এই
দ্বিধা বিভক্ত অনুভব নিয়ে সে বসেছিল। ভাবছিল। হেনার
কথাও সে ভাবছিল। ভাবতে ভাবতে এখন এই মুহূর্তে তার কোনো রাগ
হচ্ছিল না। টুকাইয়ের খুশির সুবাসের মধ্যে কি তার সমস্ত রাগ
দ্রবীভূত হয়ে যাচ্ছিল? তা
ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না রণিত। তার কি কনও অপরাধ বোধ জাগছিল মনে ? সে যে টুকাইকে হেনার মায়া মমতার
বৃন্ত থেকে উপড়ে নিয়ে চলে এসেছে তার কি অখুশি অনুভব টুকাইয়ের, তাকে কি এক প্রকার ক্লান্ত
অপরাধের ভিতর বন্ধ করছিল ? রণিত
তা বুঝে উঠতে চেষ্টা করেনি কখনো। তাকে কেবলই হেনার প্রতি এক গভীর
অভিমান অন্তরিন করে রেখেছে। আর তো কয়েক মাস পরেই লেখা পড়া করে
তাদের ছাড়া ছাড়ি হয়ে যাবে। তখন তো হেনার মুক্তি। ভাবতে
ভাবতেই রণিতের ভিতর সেই গভীর গভীরতর রাগ আবার জন্ম নেয়, বলা ভালো ভেসে ওঠে, ভেসে উঠে যেন যুদ্ধের মতো পল্টন
সাজায় সেই চণ্ডাল রাগ। তার ইচ্ছা করছিল সে টুকাইকে এমন
কথাও লুকিয়ে রাখবে যাতে হেনা কখনো খুঁজে না পায়! কিন্তু পরোক্ষনেই সে মুষড়ে পড়ে। কারণ
টুকাই! টুকাইয়ের উপর কি তবে অবিচার হবে না?
হটাত টুকাই
তাকে ডাকল
বাবা কি ভাবছ ? খেলবে না ?
খেলব বাবা।
তবে বন্দুক
নাও।
রণিত বন্দুক
নিলো। নিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে সে টুকাইয়ের দিকে তাকাল।টুকাইয়ের
খেলাটা সে বুঝতে পারছিল না।
বাবা, ওই অন্ধকার ছায়াগুলোকে গুলি করে
দাও।
বলে সে বন্দুক
তাক করার ভঙ্গি করে দেখাল। যেন সে জেনারেল টুকাই, গলা তুলে চিৎকার করে বলল—ফায়ার!
রণিত এবার
খেলাটা বুঝতে পারল। সে বন্দুকের ট্রিগারে চাপ দিল। শব্দ
ওলা বন্দুক ঘড় ঘড় করে শব্দ করল।
রণিতের মনে হল
চারিদিক থেকে যেন এক ঝাঁক পাখি উড়ে গেলো। পাখিরা সব
ছায়ার থেকে আলোর দিয়ে উড়ে যায় যেন। টুকাই হাত তালি দ্যায়। সে
আবার জেনারেলের মতো ফায়ার করার হুকুম করে।
রণিতেরও খুব
আমোদ লাগছিল। সে যেন ছেলেবেলার অভিনয়ে মেতে উঠেছে। তার
দুটো মোবাইল ফোন সে বন্ধ করে রেখেছে। সে যেন সভ্যতার যাবতীয় যোগাযোগের
অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছে। অফিস থেকেও সে ছুটি নিয়ে নিয়েছে। এখন
শুধু খেলা, কেবল খেলা। রণিতের
পৃথিবীও এখন খেলার পৃথিবী। টুকাইয়ের মতো।
রণিতের বাবা
প্রশান্তবাবু রণিতের এই পরিবর্তন লক্ষ করছিল। রণিত
প্রায় সপ্তাহ অধিক ছুটি নিয়ে বসে আছে। রণিত এতো দিন
কেন ছুটি নিয়ে বসে আছে ? কোনো
কিছু গোলমাল কি ? তাঁর
ভাবনা হয়। তা ছাড়া রণিতের মা’ও
বলছিল রণিতের চোখ মুখ যেন বদলে গিয়েছে। রণিত যেন সেই
আগের উচ্ছল স্বাভাবিক রণিতের ছায়া, কিংবা
এক অন্ধকার ছায়ার নীচে যেন রণিত চাপা পড়ে গিয়েছে। বুড়ো
বয়সে সন্তানের ভাবনায় বাবা মা যেন শতখন্ড হয়ে যাচ্ছে। সেভেনটি
আপ বয়সেও প্রশান্তবাবু বেশ শক্ত পোক্ত আছেন। রোজ সকালে এক
ঘণ্টা হাঁটেন, বাগানের
পরিচর্যা করেন। কিন্তু রণিতের নিয়ে ভাবনা তাকে টুকরো টুকরো করে
ফেলছে আজকাল। বৃদ্ধ বয়েসে একটা অন্ধকার ছায়া যেন তাঁদের ঢেকে
ফেলছে। হেমন্তের সন্ধ্যার মতো দুঃখী করে রেখেছে তাঁদের। প্রথম
ধাক্কা ছিলো হেনার সঙ্গে রণিতের বিচ্ছেদ। হেনা তো কতো
মায়া মমতায় ভরা মেয়ে ছিল। সে বৌমা নয়, মেয়েই ছিল যেন তাঁদের কাছে। কিন্তু
কি হয়ে গেলো, বা কেন এমন হল
এটা নিয়ে অন্ধকারেই আছে প্রশান্তবাবু। রণিত ও কিছু
বলল না। হেনাও কান্না কাটি করল একদিন ফোন করে, কিন্তু স্পষ্ট করে কিছু বলল না। সে
চলে গেলো বাড়ি ছেড়ে। এখন তাঁরা শুনছেন পাকা পাকি ভাবেই
এবার ছাড়া ছাড়ি হয়ে যাবে ওদের। টুকাইয়ের কথা কি কেউ ভাবল না ?
রণিত যখন
টুকাইয়ের সঙ্গে খেলছিল তখন প্রশান্তবাবু এলেন রণিতের ঘরে।
রণিত তোর
অফিসের ছুটি ক’দিনের ?
রণিত প্রথমটায়
যেন শুনতে পায়নি। প্রশান্তবাবু আবার ডাকতে সে চোখ তুলে তাকাল। যেন
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল।
ছুটি ?
সে যেন
প্রশ্নটা বুঝে উঠতে পারছে না।
ক’দিনের
ছুটি নিয়েছিস রে ?
বাবা, এখন তো ছুটি! খেলছি দেখছ না !
প্রশান্তবাবু
একটা চেয়ারে বসলেন।
কি খেলছিস ?
রণিত প্রশ্নটা
শুনে টুকাইয়ের দিকে তাকাল।
কি খেলা খেলছি
বলতো টুকাই ?
যুদ্ধ যুদ্ধ
খেলা।
রণিত আবার
প্রশান্ত বাবুর দিকে ফিরল, বন্দুক
তাক করল
যুদ্ধ!
বলেই ঘড় ঘড়
করে বন্দুক চালিয়ে দিলো।
রণিত, হেনাকে ডাকবে না এই খেলায় ?
হেনা?
রণিত আবার
শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল। যেন সে একটা ভাঙ্গা চোরা সমাধি
ফলকের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা মৃত সম্পর্কের সমাধি। সে আর
মৃত কোনো কিছু আস্ত রাখবে না, সব সে
বন্দুকের গুলিতে ভেঙ্গে উড়িয়ে দেবে। হেনাকে কি সে মনে করতে পারছে না ? নাকি হেনা পুরানো হয়ে গিয়েছে তার
কাছে! যেকোনো পুরানো কিছুই মৃত রণিতের কাছে। সে সব নতুন
করে চায়। হেনাও তো পুরানো।
প্রশান্তবাবু
আবার প্রশ্নটা করলেন
রণিত, হেনাকে নিয়ে খেলবে না ?
না, না, হেনাতো বড় হয়ে গিয়েছে, আর পুরানো, সে
খেলতে পারবে ?
রণিতের যেন
ভীষণ সন্দেহ হয়।
প্রশান্তবাবু
অতিস কে ডেকেছিলেন। তাঁর বন্ধু, ডাঃ অতিস সোম, পণ্ডিত মানুষ। ডাঃ
সোম বাইরে থেকে ডাক দিলেন
প্রশান্ত কোথয়?
প্রশান্তবাবু
তাঁকে নিয়ে এসে আর একটা চেয়ারে বসতে দিলেন ।
রণিত বাবা
কেমন আছো ?
রণিত ঘাড়
ফেরালো।
সোম কাকু কখন
এলেন ?
এই, তো। এ কি
কারেন্ট আছে তো, হ্যারিকেনের
আলোয় কি করছ ? প্রশান্ত
আলোটা জ্বেলে দাও ভাই !
প্রশান্ত
আলোটা জ্বেলে দিলেন।
রণিত সহসা
চমকে উঠল। ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল
বাবা, আলোটা নিভিয়ে দাও, নিভিয়ে দাও বলছি, আমি খেলছি !
ডাঃ সোম ইশারা
করলেন।
প্রশান্ত বাবু
আলোটা নিভিয়ে দিলেন আবার।
ডাঃ সোম গল্প
শুরু করলেন রণিতের সঙ্গে।
তারা টুক টুক
করে অনেক গল্প করলেন। যুদ্ধের কথা। খেলার
কথা। হেনার কথাও। রণিত বলল, হেনা পুরানো হয়ে গেছে।
রনিত আর টুকাই
আবার খেলতে থাকল।
প্রশান্তবাবু
আর ডাঃ সোম বেরিয়ে এলেন।
কি বুঝছ সোম ?
প্রশান্ত এ
একটা জটিল অবস্থা। রণিতের মাথার মধ্যে, একটা ওলটপালট ঘটে গেছে। কিন্তু
সেটা কেন হল সেটা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।
বৌমার সঙ্গে
বিচ্ছেদ এর জন্যে কি ?
না তা নয় মনে
হয়, এটার জন্যেই
বিচ্ছেদ।
বৌমাকে একবার
আনতে পারবি ? কথা বলব ।
চার
হেনা যখন সুবিমলের
সঙ্গে পথ হেঁটে ফিরল তখন তার মনে হচ্ছিল সে যেন একটা নদীর ধার থেকে ফিরে এলো। একটা
সময়ের নদী যেটা কেবল বহে যায়। কখনো ফিরে আসেনা মোটেই। সে
যেন নদী তীরে বসে বসে নদীর কল্লোল শুনছিল। সুবিমলের কথা
শুনছিল। সুবিমল পথ চলতে চলতে অনবরত কথা বলছিল। কেবলই
বলছিল। বলছিল, সে টুকাইকে তাদের কাছে রাখতে চায়। তার
কথা শুনে হেনার বেশ নিশ্চিন্ত হবার কথা কিন্তু, তা কি সে হতে পারছে? এই চরাচরের সমস্ত আলো ছায়া তাকে যেন ক্রমাগত ঘুরিয়ে মারছে। কেবলই
ঘুরিয়ে মারছে। হেনা কথাও স্থির হয়ে থাকতে পারছে না। রণিতকেও
তো সে কতো ভালোবাসতো। এখনও কি বাসে না ?
হেনা নিজের
আয়নার কাছে প্রশ্ন করে। আয়না কি মিথ্যা বলে ? তা হলে ? রণিত কেন তাকে দূরে সরিয়ে দিলো? নাকি হেনা নিজেই দূরে সরে এলো। রণিত
কেমন বদলে গেলো। একদিন খুব মার খেলো হেনা। সেদিন
রনিতের চোখমুখ দেখে কেমন ভয় পেয়ে গেলো হেনা। একটা আশ্চর্য
ভয়। তার পর রোজ রোজ ভয়। টুকাইয়ের
জন্যে একটা খেলনা বন্দুক কিনে এনেছিল হেনা। কিন্তু সেটা
নিয়ে কেমন ছেলেমানুষের মতো খেলতে শুরু করল রণিত।
হেনা যেন রোজ
কানের কাছে শুনত—“পালাও হেনা, পালাও”। একটা
ফাঁকা মাঠের মধ্যে যেন হেনা একা। সেই মাঠে একটি মরা আর শুকনো গাছ। গাছের
অজস্র পাখিগুলো বন্দুকের শব্দে পালিয়ে যাচ্ছে। উড়ে
যাচ্ছে। হেনা কোথায় উড়ে যাবে? গাছের শুষ্ক ডালপালা একশ হাত হয়ে
তাকে গিলে নিতে আসছে। হেনা দৌড়ায়। সেই
থেকে হেনা ছুটে বেড়ায়। নিজের থেকে। নিজের
ভালবাসার থেকে। একদিন একটা ব্লেড নিয়ে রণিত বলেছিল—“এই
হেনা, হেনা, আমার হাতটা কেটে দাও, দ্যাখো যুদ্ধের সৈনিকের গা থেকে
কেমন রক্ত পড়ে”! হেনা ভয় পায়। সে
পালাতে চায়। রণিত তার চুলের মুঠি ধরে ফিস ফিস করে বলে—“ পালাও হেনা, হেনা মেরি জান, পুরানো মানেই মৃত তুমি”!
এ সব দু এক
মুহূর্তের প্যাশন রণিতের। পরোক্ষনেই সুস্থির হয়ে যায় সে। হেনা
ডাক্তারের কথা বলেছিল। রণিত আবার রেগে গেছিল। “আমি কি পাগল? পাগলের সাথে থেকো না তা হলে”।
হেনা আলো বন্ধ
করে আয়নার সামনে বসে ছিল। আয়নায় সে কি অন্ধকারের প্রেত
দেখছিল ? একটা ছিন্ন
ভিন্ন ভালোবাসার প্রেত সে দেখছিল। তখনি শশুর-বাবার ফোন এলো। হেনা
অনেক্ষন কথা বলল। প্রশান্তবাবু সব কথা বললেন, ডাঃ সোমের কথা বললেন। শেষে
অনেক আকুতি নিয়ে বললেন—“আসবে হেনা? একবার আসবে ?”
হেনা ফোনটা
হাতে নিয়ে বসে থাকল । চারপাশে তার যেন অঝোর বৃষ্টি ঝরছে। বৃষ্টির
ভিতরে বৃষ্টি, তার ভিতরে
আবার বৃষ্টি। তার ভিতর একাধিক বৃষ্টির স্তর। রণিতের
ফোন সুইচ অন করে দিয়েছে প্রশান্তবাবু, হেনা যেন ফোন করে। হেনা তাই ফোন
হাতে নিয়ে বসে আছে। এক রকম অনন্তকাল বসে থাকার মতো
তার ভঙ্গি। কিন্তু হেনা বুঝে উঠতে পারছে না, সে কি করবে? সে কি করবে ? সুবিমলের তিনবার ফোন এলো। হেনা
ফোন ধরল না। সুবিমলের ডাক সে শুনতে পাচ্ছিল না।
এই রকম কম বেশী
অনন্ত, প্রায় সকল
মানুষকে অধিকার করে থাকে। সেই অধিকারের ভিতর মানুষ কোনো কূল
কিনারা পায় না। তখন কি মানুষকে ব্যাধের মতো মনে হয় না! সে বুনো
হাসের পিছনে ছুটে বেড়ায়। বেড়াতে বেড়াতে সে গ্রাম, শহর, রাজনীতি সকলের সামনেই একবার করে
থমকে দাঁড়ায়। কিন্তু ভিন্ন সময়ে তার দাঁড়াবার ভঙ্গি ভিন্ন। সেই
নিশ্চিত ভঙ্গিকে সে অস্বীকার করে একটা মাঠে গিয়ে দাঁড়ায়। মাঠে
মানুষ নেই, গাছপালা নেই, কেবল ছায়া। ছায়া
আর বৃষ্টি। কিংবা হেমন্তের মাঠে বৃষ্টি নেই। অথবা
আছে। হেনা ঠিক জানে না। রণিতের গলা
ফোনের ভিতর শূন্য মাঠে বাতাসের ফিস ফিসের মতো শুনছে হেনা। রণিত
কিন্তু বৃষ্টির কথা বলছে। হেনা দেখছে সেও বৃষ্টিতে ভিজে
যাচ্ছে। হেনার চোখ ঝাপসা। সে
কিছু দেখতে পাচ্ছে না। বৃষ্টির শব্দে সে কিছু শুনতেও
পাচ্ছে না। তার অনন্ত সত্ত্বার ভিতর শুধু সিক্ত এবং
রোমাঞ্চিত এক আবেগ অপেক্ষা করে।
কোন মন্তব্য নেই