“কলোনি কোলকাতা”— প্রশান্ত সরকার / অভিজিৎ বেরা
“পাখির ডিমের মত খ্যাতিহীন দুরের ছোট্ট শহর, পাখির
ডিমের মতই পড়ে আছে—কলকাতার অলিতে গলিতে
আবার দুঃখিত এক জীবন বয়ে বেড়াচ্ছি আমি”
(ভাস্কর চক্রবর্তী / এসো সুসংবাদ এসো)
প্রশান্ত সরকারের “কলোনি কোলকাতা” বইটির মুল সুর ভাস্কর চক্রবর্তীর এই তিনটি লাইনেই বলা হয়ে যায়। এই মস্ত বড় শহরটার মধ্যে যে আরও কত কত ছোট ছোট কলকাতা লুকিয়ে আছে। বইএর ব্লার্বে লেখাঃ “ একটি খুঁটিনাটি শহর যার কোনও জন্মলগ্ন নেই, কাটা দাগ নেই…যার আলো আছে শুধু আর তার ভেতর খানিকটা আলাপ যা শুধুই অনবরত দুলতে থাকে আর মাথার ভেতরে বুনতে থাকে একটা বোধের সাম্রাজ্য”। যেমন “আত্মীয় স্বজন কবিতাটি—
“ বাড়ি তো আসলে একটি গাছ
বাবা কখন তার শিকড় হয়ে… কতদূর যেন
আমরা দুভাই তার গায়ে গায়ে, লেগে থাকা
বাকলের মত…”
কিংবা শেষ তিন লাইনে—
“ বাবা তখনো ছড়িয়ে পড়ছে, ঝুঁকে পড়ছে
আরও একটু মাটির গোপনে
আর মা একটু নুন খুঁজে মরছে, সারাঘর”
শেষ লাইনটি লক্ষ্য করুন। প্রতিটি বাড়িই তো আসলে একটি গাছ, প্রতিটি বাবাই তার রক্ত জল ঘাম দিয়ে সংসারকে দাঁড় করান যেমন শিকড় মাটি থেকে জল লবণ খাদ্য নিয়ে গাছটিকে বাঁচিয়ে রাখেন। কিন্তু শেষ লাইনটি অমোঘ। “আর মা একটু নুন খুঁজে মরছে, সারাঘর”। এই এক লাইনেই কবিতাটি একটি ভিন্ন উচ্চতায় গিয়ে শেষ হচ্ছে। আসলে কবিতাটি শেষ হচ্ছে না কোথাও। মায়েরা তো নুন খুঁজেই চলেছেন সারা জীবন।
“পরীকথা” কবিতায় এসেছে কলকাতার বেশ্যাদের কথা, তাদের খিদের কথা। কিন্তু এই দুটি লাইন—
“লিপগ্লস, হাইহিল, মৃত প্রজাপতি ডুবে গেল
শেষমেশ, বুকে নিয়ে বিবাহবাসর…”
ওরাও তো মেয়ে। ওরাও তো মানুষ। ওদেরও তো ইচ্ছে হয় বিবাহবাসরের…। কিন্তু ওরা যে বেশ্যা। ওরা তো আর বাস্তব মানুষী নয়, যেন কোনও জাদুগল্পের পরী। ওদের কোনও ইচ্ছে থাকতে নেই, বিয়ের প্রজাপতি ওদের জন্য মৃত। নাকি ওরা নিজেরাই থেঁৎলে মেরে ফেলে সেই সব সুখী সুখী প্রজাপতিদের?
“কবরডাঙা” কবিতাটি অদ্ভুত। মৃত্যুর অনুষঙ্গ আছে। প্রবলভাবেই আছে।
“অথচ শরীরের কাঠ তখনো নেভেনি…
এদিকে কাঠের শরীর জ্বলছে…”
কিন্তু কবিতাটি মৃত্যুর নয়। একটা গ্রাম ছিল, ইস্কুল ছিল সেখানে। এখন কি নেই? ওরা মৃত? সেইসব দিনগুলি মৃত? বারোমাস যেখানে তারারা জ্বলত? আমি কি মৃত নই আজ? তবু মা চাঁদের কপালে চাঁদ টি দিয়ে যায়। এই শেষ লাইনে কবিতাটি কিন্তু প্রবলভাবে বেঁচে থাকার কথা বলে যায়।
আসলে প্রশান্তর কবিতায় শেষ লাইনগুলি বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
“ বাঁশি তো স্বরেরই স্খলন ছাড়া আর কিছু নয়।”
“দুধের দাঁতে শিহরণ কিছুটা তখনও শরীরি ”
আরেকটা অদ্ভুত লাইন—
“ ঠোঁটের গড়ন দেখে বেশ বোঝা যায়
কেউ কেউ এখন অতিথি বৎসল”।
“নাবিক ভরসা দিলে যে কেউ ব্যাপারী”
“তারপর আলো শেখাবে কেউ মা ডাকের পর—”
এই লাইনগুলি নিজেরাই একেকটা পৃথক সম্পূর্ণ কবিতা হয়ে যায় না কি?
“এই ঘাস—এর নীচে” কবিতাটি জীবনানন্দ দাশকে উৎসর্গীকৃত।প্রকৃতির কিছু চিত্রকল্প আছে মাটির ওপরে আহত ডাহুক, মাটির নীচে পোকাদের তুমুল সহবাস। তাদের জন্মের শব্দ। কবি মাটিতে কান পেতে শুনছেন। ভেতরে হ্রদে জলের শব্দ, কারা দাঁড় বেয়ে যায় মাটির তলায়।
ছা পোষা বাঙ্গালির ঈশ্বরী আসলে কোনও ঈশ্বরী নয়। জ্যান্ত মানবী। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “ যা চেয়েছি, যা পাব না” কবিতাটি মনে পড়ে।
“ তুমি দেবী, ইচ্ছে হয় হাঁটু গেড়ে বসি
মাথায় তোমার করতল, আশীর্বাদ…
তবু সেখানেও শেষ নেই
কবি নয়, মুহূর্তে পুরুষ হয়ে উঠি
অস্থির দুহাতে
দশ আঙ্গুল আঁকড়ে ধরতে চায়
সিংহিনীর মত ওই যে তোমার কোমর
অবোধ শিশুর মত মুখ ঘষে তোমার শরীরে
যেন কোনও গুপ্ত সংবাদের জন্য ছটফটানি”
“ আমার ছাপোষা ঈশ্বরীকে” কবিতায় প্রশান্ত একইভাবে সরস্বতীকে রক্তমাংসের মানবীরূপে কল্পনা করেছেন।
“বেলপাতায় রক্ত ঘষে তিনবার লিখে রাখি নাম
বলো পাপ নেবে না প্লিজ…”
এ কবিতায় কোনও হিপক্রিসি নেই। তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ—
“ যতই ঈশ্বরী হও, লোভ তো মানুষেরও হয়” এবং এ সহজ স্বীকারোক্তি কবিতাটি পাঠককে পাঠের আনন্দ দেয়।
ছোটবেলায় মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়ে ওঠা সবাই হাতে বোনা সোয়েটার পরত। মায়েরা অবসর পেলেই বসে জেতেন হাতে কুরুশ নিয়ে। “ ডিসেম্বরের গান” কবিতায় এই ছবিটিই কী সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন প্রশান্ত। “ এ বছর শীত তেমন এল না বলে/ সোয়েটার উল খুলে খুলে/ কুরুশকাঁটায় ফোর তুলছে একান্নবর্তী।” ফোর মানে কি চার? চার বছরের জন্মদিনে ফোর লেখা সোয়েটারটি উপহার দেওয়া হবে তাকে? একটি দীর্ঘতম দিনে? মানে বড়দিনে?
আসলে প্রশান্তর কবিতায় সংকেত, ইশারা, চিহ্ন এসবের ব্যবহার প্রবল। যেন দূরে পাহাড়ের মাথায় একটি কুপি জ্বলছে। অনেক নিচ থেকে কেউ সেটি দেখছে, বুঝতে পারছে না কুপিটি নড়ছে কিনা, কেউ ধরে আছে কিনা? কোনও গৃহীর উঠোনে নাকি কোনও আদিম গুহায়? কিন্তু বোঝা যাচ্ছে সেটি জ্বলছে। জয় গোস্বামীর একটি কবিতায় আছে—
“ সংকেত। ইশারা। চিহ্ন। জ্বলে ওঠে কুপ।
কি বলে মর্মর? ঢেউ? পাতা খসা বন?
মাটিতে সমস্ত রাত উৎকর্ণ শ্রবণ
যদিও সে মাটি স্তব্ধ। আদিগন্ত চুপ।”
প্রশান্ত সরকারের “ কলোনি কোলকাতা” পড়ে অনেকক্ষণ এভাবে চুপ হয়ে বসে থাকতে হয়। স্তব্ধ হয়ে।
“ওই দেখো মাঠের মধ্যে আগুন ফোয়ারা। ”
কোন মন্তব্য নেই