না উদাস হো মেরে হমসফর / কিরীটী সেনগুপ্ত
বলা হয়, কবিতার বই কেবল কবিরাই কেনেন! সাধারণ, অ-কবি ক্রেতা নাকি হাতে গোনা।
সত্যিই তাই? তাহলে ইংরেজিতে অনূদিত, বাংলা-কবিতার বাঙালি কবি-ক্রেতা এতো কম কেন? এই
বাংলায় আর যাই হোক, বাঙালি কবির সংখ্যা তো মন্দ নয়। বাংলা কবিতা লেখেন, এবং তার ইংরেজি
অনুবাদে ইচ্ছুক কবির সংখ্যাও বেশ, বেশ ভালো। তাহলে কি হল?
লিখেছেন কিরীটী সেনগুপ্ত
সাহিত্যের বাজার শুনলে যদি আপনার ভ্রূ কুঁচকে ওঠে এই লেখা আপনার জন্যে নয়। বই বাজার পড়লে যদি বাঁকা হাসি আপনার ঠোঁটের কোনে দেখি, এই লেখায় মন্তব্য করা থেকে নিজেকে বিরত রাখুন।
গল্প উপন্যাসের থেকে কবিতার বাজার বরাবরই দুর্বল। কবিতা পাঠকের সংখ্যা সবসময়ই কম। "কবিতা কেবল দীক্ষিত পাঠকের অধিকার" এমন কথা আমি বিশ্বাস করি না যদিও। আর সেখানে অনুবাদ সাহিত্যের বাজার কেমন হবে সেটা খুব সহজেই অনুমান করা যায়। যদি অনূদিত কবিতার কথা বলি, সে তো আরও শোচনীয়।
এমতাবস্থায় ইনার চাইল্ড প্রেস (নিউ জারসে) এবং হাওয়াকল প্রকাশন (কোলকাতা)-এর যৌথ উদ্যোগে বাংলার কবি বিভাস রায়চৌধুরীর অনূদিত কবিতার, শতাধিক পৃষ্ঠার যে পেপারব্যাক বইটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হবে আগামী সোমবার (২৮শে সেপ্টেম্বর ২০১৫), সেই বইটির ভবিষ্যৎ কেমন হবে বলে আপনার মনে হয়?
যে কবিতা অথবা কবিতাসমূহ মূল বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে, তার বা তাদের বাঙালি পাঠক কম। অথবা বাঙালি গ্রাহক কম। কিন্তু কম কেন?
বলা হয়, কবিতার বই কেবল কবিরাই কেনেন! সাধারণ, অ-কবি ক্রেতা নাকি হাতে গোনা। সত্যিই তাই? তাহলে ইংরেজিতে অনূদিত, বাংলা-কবিতার বাঙালি কবি-ক্রেতা এতো কম কেন? এই বাংলায় আর যাই হোক, বাঙালি কবির সংখ্যা তো মন্দ নয়। বাংলা কবিতা লেখেন, এবং তার ইংরেজি অনুবাদে ইচ্ছুক কবির সংখ্যাও বেশ, বেশ ভালো। তাহলে কি হল?
মোদ্দা কথা, কবিরাও কবিতার বই তেমন একটা কেনেন না। বিশেষত বাঙালি কবিরা। কবিরাও সৌজন্য কপি পাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেন মনে মনে।
অথচ দেখুন, সর্বভারতীয় স্তরে বিভাস রায়চৌধুরীর অনূদিত কাব্যগ্রন্থ ২০১৪ সালে যখন প্রথম প্রকাশিত হয়, বহু-প্রচলিত ইনফিবিম সংস্থায় গ্রন্থটি বেস্টসেলিং বইয়ের তালিকাভুক্ত হয়েছিল। রাতারাতি নয় যদিও, প্রকাশের মাস দুয়েক পরে। তবে এতো বই কিনলেন কারা?
বাংলার বাইরে বসবাসকারী বাঙালি, অবাঙালি কবি, অ-কবি পাঠক কিনেছিলেন বইটি। এক-দুটি কপি নয়, অনেক অনেক বই। যেমন দেখুন, অসমে থাকেন রিমা দাস আমাকে প্রায় তিন মাস আগে থেকে বলে রেখেছেন, বিভাস বাবুর অনূদিত বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হলেই যেন ওকে বইটির দুটি কপি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হায়দ্রাবাদে থাকেন মনু কুরুপ (ইংরেজি সাহিত্য এবং অনুবাদ বিষয়ক গবেষক) জানিয়েছেন তারও দুটি কপি চাই। একটি নিজের জন্যে, অপরটি ওর মায়ের জন্যে। মায়ের জন্যে কেন? মনুর কথায় ওর মা বাংলা সাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠিকা, এবং অনুবাদেই পড়ে ফেলেছেন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।
"পোয়েম কন্টিনিউয়াস" প্রকাশিত হওয়ার পর যখন আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া শহরের স্বনামধন্য সম্পাদক এবং কবি জি এমিল রিউটার বিভাসদার "পাগল" কবিতাটি মূল বাংলা সহ ওদের বহু-পঠিত পত্রিকায় (ফক্স চেজ রিভিউ) পুণপ্রকাশ করার অনুরোধ জানালেন, সেদিন বুঝেছিলাম বাংলা কবিতার সমঝদার, অনুরাগী পাঠক বিশ্বের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছেন। আমাদের কাজ এই পাঠকদের একটি ছাদের তলায় নিয়ে আসা। আমাদের মানে কাদের কথা বলছি, বুঝতে পেরেছেন তো? আমাদের মানে, বাংলা কবিতার সমস্ত পাঠকদের। যদি প্রকৃতই বাংলা কবিতার পাঠক এবং ভক্ত হই, আমরাই পারি, অনুবাদে বাংলা কবিতাকে পৃথিবীর সর্বত্র পৌঁছে দিতে। আর প্লিজ, কবিতার অনুবাদ হয়, কি হয়-না, এই তর্কে যাবেন না। অনুবাদেই তো আমরা তুর্কি কবিতা পড়েছি। পড়েছি তো?
এমন অনেকেই জিজ্ঞাসা করেছেন আমাকে। প্রথম সংস্করণে হাতে গোনা ৩০-টি অনূদিত কবিতা ছিল, আমার লেখা অনুবাদকের বক্তব্য, আর মার্কিন লেখক-সমালোচক ডন মারটিনের লেখা চমৎকার একটি মুখবন্ধ। ছোট্ট একটি বই, হার্ড কভার। দাম মাত্র ১২০টাকা। প্রকাশক ইনার চাইল্ড প্রেস, লিমিটেড। কোনও ভারতীয় প্রকাশক এগিয়ে আসেননি বইটির যৌথ প্রকাশনায়। তাদের ভয়। ভীত হওয়া সঙ্গত। কবিতাই পড়ে থেকে উঁই-এর খাদ্য হয়, সেখানে আবার অনূদিত কবিতা! ছ্যাঃ।
কেটে গেল প্রায় ১৬-১৭ মাস। একটা-একটা করে বই বিক্রিও হল। পাঠক প্রশংসা করলেন। লিখলেন। লিখে জানালেন। সমালোচকেরা সমালোচনা লিখে পাঠালেন বহু পত্র পত্রিকায়। সে সব প্রকাশ পেল মিউজ ইন্ডিয়া, রেড ফেজ, ফক্স চেজ রিভিউ, একাধিক ব্যক্তিগত ব্লগে। দেশে-বিদেশে সর্বত্র। ফিলাডেলফিয়া-র ঐতিহ্য মণ্ডিত রায়ার্স মিউজিয়াম এবং লাইব্রেরিতে বইটি জায়গা পেল। হায়দ্রাবাদ থেকে প্রকাশিত তুলনামূলক সাহিত্য এবং অনুবাদ সাহিত্যের প্রামাণ্য পত্রিকায় প্রকাশিত হল পোয়েম কন্টিনিউয়াসের সপ্রশংস আলোচনা। কেবল পাঠক নয়, শুধু কবি নন, এই বইটির সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন অনেক অনেক মানুষ। কবিতা প্রেমী সমালোচক, অধ্যাপক, গবেষক। ওদের মেল বন্ধনের একটি যোগসূত্র। বাংলা কবিতা। কবিতা। এবং একটিই মাধ্যম। অনুবাদ।
ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে বিভাস রায়চৌধুরীর আরেকটি বাংলা কবিতার বই। অনন্ত আশ্রম। প্রকাশক সিগনেট প্রেস। পাঠক, সমালোচক, নিন্দুক নির্বিশেষে জানালেন, আ ল্যান্ডমার্ক বুক ইন বেঙ্গলি পোয়েট্রি। নতুন উদ্যমে শুরু করলাম অনুবাদ। কুড়িটি কবিতা সংযোজিত হল। এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায়। বিগত ১৬মাস বইটি ঘিরে সমালোচকের মন্তব্য, প্রশংসা জুড়ে দিলেন ভারতীয় প্রকাশক হাওয়াকল। অনুমোদন করলেন মার্কিন প্রকাশক ইনার চাইল্ড প্রেস। নতুন করে লিখলাম আমার বক্তব্য। দীর্ঘ আলোচনা। আমার নিজের। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে যা যা ইনপুট পেয়েছি এই বইটি নিয়ে, সব লিখে দিলাম। অনুবাদ করলাম কবি জয় গোস্বামীর দীর্ঘ আলোচনা। এ এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। ঠিক যেমন অনুভব করেছিলাম, বিভাসদার সাক্ষাৎকার লেখার সময়ে বিনয় মজুমদারের একাধিক কবিতার টুকরো অনুবাদ করার ক্ষেত্রে।
পোয়েম কন্টিনিউয়াস-এর সর্বশেষ কবিতাটির নাম এপিটাফ। জয় গোস্বামী এই এপিটাফ ঘিরেই আলোচনা করেছিলেন গোঁসাইবাগানে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন, বিভাসদার লেখা এপিটাফ কেবল সৌধফলকে প্রোথিত হওয়ার শব্দরাজি নয়, অক্ষরবৃত্তে রচিত একটা গোটা কবিতা। আমাদের দুই প্রকাশককে থামিয়ে দিয়ে অনুবাদ করলাম জয়দার আলোচনা। প্রকাশনার সময় বিলম্বিত হওয়াতে প্রকাশকদ্বয় যখন ঈষৎ রুষ্ট, আমার অনুবাদ পড়ে তারা তখন হাতে চাঁদ পাওয়ার আনন্দে বিভোর। পাঠক, মনে রাখবেন কবি বিভাসের প্রতি কোনও অতিরিক্ত ভালোবাসায় এই কাজ আমি করিনি। করেছি কেবল দুটি কারণে। ১। একটি কবিতা সংকলনে একটি এপিটাফের অন্তর্ভুক্তির যথার্থতা প্রমাণ। ২। কবিতার আলোচনা কতো নির্মল, বহুমাত্রিক এবং পরিচ্ছন্ন হতে পারে সেটা বাংলার এবং বাংলার বাইরের পাঠক, গবেষকদেরও জেনে নেওয়া আবশ্যিক।
কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে বিভাসদার সঙ্গে কতো কাপ কফি খেয়েছি, সেই হিসেব আজ আর আমার কাছে নেই। এই কফি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকেই কবির দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেওয়া এক অভিজ্ঞতা বটে। আর সেই সাক্ষাৎকার যখন খোদ মার্কিন মুলুকের অতি-প্রসিদ্ধ পত্রিকা "ওয়ার্ড রায়ট"-এ প্রকাশিত হয়, তখন কেবল অনুবাদক হিসেবে নয়, ইন্টারভিউয়ার হিসেবেও বুক ফুলে ওঠে। সেই সাক্ষাৎকারটিও আপনারা পড়তে পাবেন প্রকাশিতব্য দ্বিতীয় সংস্করণে।
আমাদের মার্কিন প্রকাশক ইনার চাইল্ড প্রেস পুরো কাজটি নিয়ে খুব খুশী। কলকাতার হাওয়াকলও। সত্যি বলছি, ওদের খুশী করতে পেরে আমি আনন্দিত। আমি ওদের কাছে দায়বদ্ধ। কৃতজ্ঞ। ফিরে আসি আমার প্রথম বক্তব্যে। অনূদিত কবিতার বাজারের তোয়াক্কা না করেই যে বিপুল ব্যয়ভার নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন ওরা, অনুবাদক হিসেবে আমার প্রাপ্তির ঘট পূর্ণ। আর আমি নিশ্চিত, যে সমস্ত পাঠকের, সমালোচকের ভালোবাসায় সমৃদ্ধ হয়েছি, তাদের শুভেচ্ছা এবং অকৃত্রিম সহযোগিতা ছাড়া এই কাজ সম্পূর্ণ হতো না।
নতুন, এবং নতুনতর পাঠক এবং গবেষকের অন্তহীন সন্ধানে…
কবিতাপ্রবাহে…
সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৫
কোলকাতা
সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৫
কোলকাতা
কোন মন্তব্য নেই