সুপ্রিয় সাহার ঈশ্বর অথবা যৌনতার গল্প
পরিণত স্টাইলের
গল্প
শীর্ষেন্দু
দত্ত
বাংলা ছোটগল্প
বরাবরই বেশ শক্তিশালী। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে অধিকাংশ বাংলা সাহিত্যিকই এই
ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। যদিও অনুবাদের দুর্বলতা ও প্রসারের
অভাবে কখনোই তা সেভাবে বিশ্ব সাহিত্যের অলিন্দে ব্যাপ্ত হতে পারেনি। সত্তর দশকের
আগে পরে থেকে বাংলা ছোট গল্পে নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষার অনুশীলন বেড়ে যায়। হাংরি
আন্দোলন বা অন্যান্য সাহিত্য আন্দোলনগুলি ছোটগল্পের ভাষ্যে স্মার্টনেস আনায়
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। নানান ভাবে গল্প বলা,জাদু বাস্তবতা,প্রতীকী ফর্মে বলা গল্পের সংখ্যা বেড়ে চলে। উদয়ন ঘোষ,বাসুদেব
দাশগুপ্ত,অরূপরতন,সন্দীপন,বলরাম বসাক,নবারুণ ভট্টাচার্য তাদের কথন স্টাইলে পাঠককে পেড়ে ফেলে নিজের জমিনে। এক নতুন
আর নিজস্ব পাঠক সমাজ গড়ে ফেলে তারা। লাতিন আমেরিকা বা তার আশপাশ মহাদেশে একের পর
এক কথা সাহিত্যিক আন্তর্জাতিক সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ করে চলে তাদের নিজস্ব ধারা
বা ঘরানা দিয়ে। গার্সিয়া মার্কেজের ম্যাজিক রিয়েলিটি বা জাদু বাস্তবতার প্রভাব পড়ে
এই বঙ্গের ছোটো গল্পেও। এজাতীয় তন্ত্রে যারা বিশ্বাস রেখে লিখতে শুরু করে সুপ্রিয়
সাহা তাদের মধ্যে অন্যতম। ‘‘ঈশ্বর অথবা যৌনতার গল্প’’ তার সাম্প্রতিক ও একমাত্র গল্পের বই। যা সদ্য প্রকাশিত।
সমস্যা হচ্ছে
সুপ্রিয় সাহাকে আমি একযুগ ধরে চিনি। তার লেখার স্টাইলের গ্রাফ লাইনটাও আমি একযুগ
ধরে জানি। এবং সবটা মিলিয়ে আমি তার কলম কুহকে প্রভাবিত। ফলত তেমন একজনের বই নিয়ে
দু দশটা কথা বলা বেশ মুশকিলের। বলার যেটা, সুপ্রিয়র এই বইটা নিয়ে বলার থেকে তার সামগ্রিক
লেখালিখি নিয়ে আলোচনা করা আমার পক্ষে সহজ হত। এ প্রসঙ্গটা আরেকটু খোলসা করে বোঝাতে
গিয়ে সেই কর্তা ঠাকুরের কথাটি মনে পরছে। যিনি আমায় এবং অনেককেই বলতেন যে,যার লেখা ভাল
লাগে তার সাথে ভিড়িসনা,আশাভঙ্গ হবে...
না,আশাভঙ্গের মতো
কিছু হয়নি। তবে সুপ্রিয়র ধারাবাহিক এক্সপেরিমেন্ট ওকে আগের লেখার স্টাইলের থেকে
ছিটকে দিয়েছে। এই বইটিতে সেই বদলী স্টাইলের সাম্প্রতিক লেখাগুলিই আছে। আটটি গল্পের
মধ্যে পাঁচটি গল্পই ২০১৫ সালে, দুটি ২০১৪, একটি ২০১২ সালে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।
পাঠককে ভাবতে বলছি, সুপ্রিয় তার গল্প নির্বাচন করতে গিয়ে প্রত্যক্ষ বা
পরোক্ষভাবে যে বার্তা দিচ্ছেন তা হল- এক ২০১৫ এর আগের গল্পগুলি সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা মূলক। দুই এখন সে তার স্টাইল খুঁজে পেয়েছে।
প্রথম গল্পটির
নাম অতনুর নামগন্ধ। নামকরণেই উদয়ন ঘোষ সুলভ গন্ধ আছে। যা দেখে পাঠক সচেতন হয়ে পরে
কোন গল্পগর্ভে তিনি প্রবেশ করতে চলেছেন। বেইমানির গল্প বা বেইমানির ছবি হিসাবে
গল্পটির বর্ণনা চলে। পড়তে পড়তে নিজেকে আবিষ্কার করি কোনো হলিউডি ফিল্মের মধ্যে।
সুপ্রিয় সচেতন ভাবেই তার কলমকে তুলির মতো ব্যবহার করতে চান। বা তার গল্প বলাটাই
যেন ক্যামেরার চোখ দিয়ে দেখা। গল্পের শুরুতেই লেখক ব্র্যাকেট দিয়ে লিখেছেন, “আক্টিভিষ্ট কাকে বলা যায়। আমাকে না অতনুকে? নাকি সবটাই ভাঁওতা”। এটাই আসল গল্প। বা এটাই গল্পের দর্শন বা গল্পের
ম্যাসেজ। সুপ্রিয়র মুন্সিয়ানা এখানেই যে, সে শুরুতেই সব কনফেস করেও গল্পটির টানটান উত্তেজনা
শেষ লাইন অবধি ধরে রাখতে পেরেছেন। এটাও একটা এক্সপেরিমেন্ট এবং সার্থক
এক্সপেরিমেন্ট।
এক্সপেরিমেন্ট
আরো আছে। ‘ছোটো পাড়ার ঘটনা’ । গল্পটি ছটি
পর্বে ভাগ করা। শেষ পর্ব তে ইটালিক স্টাইলে শুধু একটি বাক্য, “আমি ঈশ্বরকে আলোকবর্ষের সাথে তুলনা করতে পারি চাঁদের মায়ার সাথে ছায়াবিশ্বকে
মিলিয়ে দিতে পারি ব্রম্ভান্ডের সাথে সময়কে বলতে পারি একটা উল্কা পিণ্ড আর সবাইকে
স্ট্রিং থিওরিতে বেঁধে দিলে হাতে পরে থাকে একটা পাথর স্রেফ একটা পাথর”।
“যৌনতা অথবা ঈশ্বরের গল্প” তে চারটি পর্ব।
পর্বগুলির নাম এরকম-বিদিশা,লাল,ইউসুফ ও আমি। যাদের নামে অধ্যায়,সেখানে সে
বলছেনা। তার সম্বন্ধে আরেকজন বলছে। সবটাই খুব রিদমিক।
সুপ্রিয়র
বিদিশা সিরিজের তিনটি গল্প এখানে আছে। হ্যাঁ, এটি অবশ্যই এক সিরিজ গল্প। বিদিশা সুপ্রিয়র গল্পে
এলেই সুপ্রিয়র গল্পের নায়ক সব ভুলে মেতে ওঠে মধ্যবিত্ত সুলভ যৌনাচারে। পড়তে পড়তে
মনে হয় আসলে বিদিশার প্রতি গল্পের নায়কের এক গোপন দ্বেষ কাজ করে চলে। বিদিশার
গল্পগুলি প্রচণ্ড ভাবে সন্দীপনকে মনে পরায়।
‘কাঁড়বাঁশ’ গল্পটি সঙ্কলনের সেরা গল্প এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
বলতে বাধ্য হচ্ছি সন্দীপনরা একশো এক বিদিশার জন্ম দিলেও এমন কাঁড়বাঁশ ধরতে মানিক
বন্দ্যোপাধ্যায়দেরই ডাকতে হয়। এটাই সুপ্রিয় সাহার সার্থকতা। এজাতীয় গল্প লিখতে
গেলে একজন লেখকের যে রাজনীতি করণ হবার প্রয়োজন তা সুপ্রিয়র আছে কিনা জানিনা।
কিন্তু বাংলা ছোটোগল্পের রাজনৈতিক গল্পের ভাঁড়ারে ‘কাঁড়বাঁশ’ একটা মুক্তো।
পড়তে পড়তে পাঠক খেয়াল করেনা কখন কাঁড়বাঁশ তার হাতেও উঠে গেছে।
শেষ গল্পটি ‘হাসিম আলির তাবিজ কবচ’। এটিও সাম্প্রতিক বাংলা ছোটো গল্পের এক গুরুত্বপূর্ণ
সংযোজন। তবে একমাত্র এই গল্পটি পড়েই পাঠকের মনে হতে পারে অপ্রয়োজনীয় মেদ গল্পটিকে
মন্থর করেছে।
বইটির উৎসর্গের
পাতায় গিয়ে আপনার মনে হতেই পারে লেখকের আরো অনেক না বলা গল্প প্রকাশের অপেক্ষায়।
অথবা অন্তত একটি উপন্যাস।
আর যেখানেই হোক
প্রিন্টার্স লাইনে বানান ভুল মানা যায়না।
ঈশ্বর অথবা
যৌনতার গল্প।।সুপ্রিয় সাহা।।নতুন শতক প্রকাশনী,কলকাতা-২৯।।মূল্য ৫০.০০
সুপ্রিয়
সাহা-৯৮০৪৯৬৯০৯৬৮/ supriyasaha12@gmail.com ।।নতুন শতক প্রকাশনী-৯৮৩০৯০৭৭৯২
কোন মন্তব্য নেই