Header Ads

1 / 5
1 / 5
1 / 5
1 / 5
1 / 5

"লেখা তো লেখকের পরিশীলনের জন্ম!"— বিতান চক্রবর্তী

লেখক এবং প্রকাশক হিসেবে বড় রিস্ক হয়ে গেল। অপ্রিয় হওয়ার রিস্ক। গল্পকার ও প্রকাশক বিতান চক্রবর্তীকে অন্তরঙ্গ, দীর্ঘ  সাক্ষাৎকারে ধরলেন কিরীটী সেনগুপ্ত।

                            নতুন দিল্লির ইন্ডিয়া হ্যাবিট্যাট সেন্টারে গল্পকার বিতান চক্রবর্তী। ছবি সৌজন্যঃ কিরীটী সেনগুপ্ত।

কিরীটী সেনগুপ্ত: বাংলায় লেখা মৌলিক তিনটে বইশান্তিরামের চা, শরণার্থী এবং অভিনেতার জার্নাল-এর কথা আপাতত বলছি না। তোর গল্পগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের পূর্ণাঙ্গ কাজ আছে, বোগেনভিলিয়া অ্যান্ড আদার স্টোরিজ (অনুবাদক প্রণব ঘোষ, শাম্ভবী ইমপ্রিন্ট)। বইটি অবাঙালি পাঠক মহলে আদৃত হয়েছে। সমালোচকদের অঢেল প্রশংসাও পেয়েছিস। তবু একটা কিন্তু থেকে গেল। এই কিন্তুটা কী? 

বিতান চক্রবর্তী: আচ্ছা, তুমি আগে আমাকে বল শরণার্থী কীভাবে মৌলিক কাজ হল?

কিরীটী সেনগুপ্ত: শরণার্থী আমার ইংরেজি বই রিফ্লেকশনস অন স্যালভেশন-এর ছায়া অবলম্বনে লিখিত। আমি তোর বইটিকে আমার বইয়ের অনুবাদ (সে ভাষান্তর হোক বা ভাবানুবাদ) বলতে নারাজ। তুই শরণার্থী বইতে এই ছায়া অনুসরণের কথা স্বীকার করেছিস। তার মানে এই নয়, যে বাংলায় তোর লেখাটা আমার লেখার নকল। এমনকি কোনও কোনও গদ্যে তোর লেখা আমার লেখার মূল সুরের ধারেকাছেও ঘেঁষেনি। তাহলে শরণার্থী কীভাবে মৌলিক কাজ হল না?  

বিতান চক্রবর্তী: যাইহোক, তোমার প্রশ্নে আসি। বোগেনভিলিয়া অ্যান্ড আদার স্টোরিজ-এ তুমি যে কিন্তু-র কথা বললে সেই কিন্তুটা হল লেখার চলন নিয়ে। প্রবাবুর ইংরেজি ভাষা পাণ্ডিত্য নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। সমস্যা যা কিছু সব ওই চলনে। বলতে পার, অনুবাদকের মননে। প্রণববাবু অধিকাংশ ক্ষেত্রেআক্ষরিক অনুবাদের সাহায্য নিয়েছেন। বিদেশের বা অবাঙালি পাঠক যাদের ভাষার ধরন আলাদা তারা বাঙালির সেন্টিমেন্ট বুঝবে কীভাবে? ফলে তাদের কাছে মনে হয়েছে রাফ ট্রান্সলেশন দ্যাখো, বাঙালি বা অবাঙালি পাঠক বলে নয়, লেখায় পাঠককে ধরে রাখতে গেলে মায়াবৃত্তের প্রয়োজন হয়। প্রথমে লেখার দরজার ভেতর জোর করে ঠেলে দিতে হয়, তারপর যদি লেখার গু থাকে পাঠক এমনিই সেই বৃত্তে হাবুডুবু খাবে। আর, যদি সেই মায়া, সেই সত্য না থাকে, পাঠক সব বুঝেও মুখ ফেরাবে। আমি দেখেছি অনুবাদে এ কাজ আরও কঠিন। একটি অন্য ভাষার কাজ আমার নিজের ভাষায় নিয়ে এসে ফেলার কাজ যে খুব সহজ নয় তা আমিও অনুবাদ করতে গিয়ে হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছিলাম শরণার্থী-এর কাজ করতে গিয়ে। ইংরেজির (বা অন্য কোনও ভাষা) নিজস্ব কিছু চলন আছে, আমরা বলি নুয়ান্স,যেগুলি বাংলায় নেই। যে কথা ইংরেজিতে খুব সহজে বলা হয় বা যায়, বাংলায় তা বললে খারাপ শুনতে লাগে। বাংলা নিজেই এত ভাব-রস ভরা ভাষা, তাতে খুব কঠিন (খারাপ) কথা বলতে বা লিখতে গেলেও ওই ভাবের রস মিশেই থাকে। আবার বাংলায় আমরা যেভাবে ভাবকে নিয়ে চলি ইংরেজিতে সেই ভাব ঠিক সেভাবে চলে এলে গ্যাদগ্যাদে লাগবেই। আর প্রণববাবু ঠিক এখানেই হয়ত  অনুবাদকের সাফল্য থেকে দূরে সরে গেছেন। এখানে আরও একটা কথা বলি, এই সরে যাওয়াটা কিন্তু অনুবাদকের একার নয়, আমারও। আমার মূল লেখাতেও বাক্যের গঠন বেশ জটিল (ঠিক আমারই মতো), যার ফল অনুবাদে পড়তে বাধ্য।  

কিরীটী সেনগুপ্ত: বাঙালি মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তের জীবনযাপন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হলে অবাঙালি পাঠকদের কাছে ইংরেজিতে অনূদিত বইটি কি আরও সমাদর পেত বলে তোর মনে হয়? খেয়াল রাখিস, সাধারণের জীবনকথা সম্পর্কে বাঙালিদের মধ্যেও যে প্রবল কৌতূহল আছে এমন নয়।  

বিতান চক্রবর্তী: কৌতূহল? কৌতূহল মানুষকে জ্ঞান দেয়। পন্য-সভ্যতা এবং লোভ সেই কৌতূহল থেকে দূরে রাখে আমাদের। প্রতিদিন তো কাজের সূত্রে এত লোকের সাথে মেশো, বুকে হাত রেখে বল, কতজনকে দেখেছো কৌতূহলী জীবন সম্পর্কে, সমাজ সম্পর্কে, বিশ্ব সম্পর্কে? আমার মনে হয় কৌতূহল বিষয়টাই আজকাল লুপ্ত। আমরা অন্ধের মতো অহং-এর উপর বিশ্বাসী হয়ে উঠছি। সেখানে অবাঙালি পাঠক বাঙালি প্রান্তিক সমাজ বা মধ্যবিত্ত্ব সমাজ নিয়ে কৌতূহলী হবেন এটা কল্পনা করাও অন্যায়। ওই যে বললাম, লেখককে নিজের লেখায় এক মায়াবৃত্ত তৈরি করতে হয়! যদি সেই বৃত্তে ফাঁক থাকে তবে পাঠক ছিটকে যাবেই।বোগেনভিলিয়া অ্যান্ড আদার স্টোরি-এ সেই সমস্যাটাই হয়েছিল। একজন অবাঙালি পাঠকে যতই রসিয়ে কসিয়ে বল না কেন শীতের রাতে বেগুন পোড়া এবং রুটি খাওয়ার গপ্প, যতক্ষণ না নিজের চেখে তিনি দেখছেন, জিভে স্বাদ নিচ্ছেন, তিনি কিন্তু এই রস থেকে বঞ্চিত হবে। আর সাহিত্যে এই কাজটি করতে হয় বড় মায়া দিয়ে, অনূদিত টেক্সট নিজের লেখা না করে তুলতে পারলে সেটা আরোপিত মনে হবে। পাঠক কোনওভাবেই সেই লেখার সাথে নিজেকে রিলেট করতে পারবেনা। তুমি এটা বুঝবে, কারণ তুমি নিজেও অনুবাদ কর; আবার এই তুমি, বা লিন্ডা যখন তোমাদের কবিতায় বাঙালি অনুষঙ্গ নিয়ে আসো তখন বিদেশের পাঠক বা অবাঙালি পাঠক কি সেটা বুঝতে পারে না? পারে, কারণ তোমরা পুরো লেখাটায় অবাঙালি পাঠককে তারা যে তরঙ্গে অভ্যস্ত সেই তরঙ্গে এনো ফেলো, বাকিটা তারা রিফ্লেক্সে, কল্পনায় ভরিয়ে নেন। ওই তরঙ্গটা গুরুত্বপূর্ণ। তুমি আমাকে বল, তুমি এমন পরিস্থিতিতে কোন উপায় অবলম্বন কর? আলাদা কিছু কি?

কিরীটী সেনগুপ্ত: মহা মুশকিলে পড়া গেছে! এখানে প্রশ্নকর্তা আমি। উলটে তুই আমাকে প্রশ্ন করছিস? শোন, উপায় আলাদা নাকি সমান আমি সেভাবে বলতে পারব না। ভেবে দেখিওনি কোনও দিন। যেহেতু ইংরেজিতে লেখালিখি করি, ভাষার চলন কিছুটা হলেও বুঝি, জানি। আর, অনুবাদ করার সময় আমার প্রধান টার্গেট হল, যাদের জন্য অনুবাদ করছি তারা বুঝতে পারবেন কিনা সেটা বিভিন্নভাবে যাচাই করে নিই আমি। মূল লেখক বা কবি অসন্তুষ্ট হতে পারেন, কিন্তু এক্ষেত্রে আমার একটাই কথা, আমি নিজের খেয়ালে অনুবাদ করতে বসিনি, আমাকে বলা হয়েছে অনুবাদ করতে। আমি যা লিখছি সেটাতে আমার নিয়ন্ত্রণ থাকবে পুরোটাই। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, অনুবাদকের সাফল্য লেখক উপেক্ষা করলেও অনুবাদকের ব্যর্থতা তাঁকে আহত করে। যে বইটি ১০০ শতাংশ অনুবাদকের খাটনির ফসল, সেই ফসলে পোকা লেগে গেলে মূল লেখকের করণীয় কী?

বিতান চক্রবর্তী: সত্যি কি কিছু করবার থাকে? অনুবাদক যখন অনুবাদ করেন সেই ফসলের দাবিদার একমাত্র অনুবাদকই। যদিও পণ্ডিত সমাজ তা মনে করেন না। তাতে কারই বা কী এসে যায়! বিভাসদাকে (কবি বিভাস রায়চৌধুরী) বহুবার বলতে শুনেছি, অনুবাদে মূল লেখক মৃত। কারণ, যিনি অনুবাদ করে অন্য ভাষায় নিয়ে যাচ্ছেন মূল লেখাটিকে, মূল লেখক যদি সেই ভাষাটা জানতেন তাহলে তিনি ওই ভাষাতেই লিখতেন! মূল লেখক সেই ভাষার অলি-গলি চেনেন না বলেই অনুবাদকের সাহায্য নেন, অনুবাদক সেই গলিগালা চেনেন এটা ধরে নিয়েই। ফলে যিনি রাস্তা চেনেন রাস্তা তারই। মূল লেখক তার দাবিদার হতে পারেন না। এবার যদি অনুবাদক ব্যর্থ হন তাহলে তার দায় অনুবাদকেরই। এবার যদি অনুবাদক বলেন, ভাই, মূল লেখাটাই অনুবাদের যোগ্য নয় তাহলে আমার প্রশ্ন, হে অনুবাদক, আপনি তাহলেঅনুবাদের দায়িত্ব নিলে কেন? তোমার মনে আছে, তোমার কত লেখা আমি অনুবাদ করতে গিয়েও করতে পারিনি, কারণ ওই লেখাগুলি সত্যিই অনুবাদ করা সম্ভব নয় বলেই আমার বিশ্বাস। সব লেখা অনুবাদ করা সম্ভব নয়, এটা যেমন অনুবাদককে বুঝতে হবে, তেমনই মূল লেখককেও বুঝতে হবে। তুমি নিজে পারবে সব লেখা অনুবাদ করতে? তোমাকে যদি বলি সুকুমার রায় অনুবাদ কর?

কিরীটী সেনগুপ্ত: চেষ্টা করতেই পারি, কিন্তু আমার কয়েকটি শর্ত থাকবে। সুকুমার রায়ের ছড়া থেকে আমি ছন্দ সরাতে বলব। বলতে পারিস, ছন্দ সরালে সুকুমার রায়ের আর কী বাকি থাকল? আমি বলব, এক্সকিউজ মি! যাইহোক, যে জীবনচর্যা থেকে তুই, আমি বা আমরা উঠে এসেছি, সেই জীবনের প্রতি তুই দায়বদ্ধ। এটা বুঝতে পারি তোর গল্প আর গদ্য পড়ে। আমার প্রশ্ন, এই দায় কি তুই তোর লেখকজীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত বয়ে বেড়াতে চাস?

বিতান চক্রবর্তী: দাবি করতে পারি না যে নিয়েই যাব। তবে জান-প্রান দিয়ে চেষ্টা করব জীবনের প্রতি দায়বদ্ধতা দেখাতে। এটাই তো জীবনের পরীক্ষা। সাধনা। ঈশ্বর আমাকে যে জীবন দিয়েছেন, তার থেকেই বাকি পৃথিবীকে দেখি, সেই আসল জন্মকে অস্বীকার করি কীভাবে? আরোপিত জীবনে প্রাণ থাকে না; স্মার্টনেস থাকে, চমক থাকে; কিন্তু প্রাণের সহজ কথাটুকু থাকে না। আর চালাকি আমার নাপসন্দ। আমি বিশ্বাস করি, এই বিশালে আমি একটি ইউনিট মাত্র। আমার জন্য নির্দিষ্ট কিছু কাজ আছে এই সভ্যতার জন্য, যেমন আর সবার থাকে। আমি যদি সেই দায়, সেই কাজ থেকে মুখ ফেরাই সভ্যতাও আমাকে কুচলে চলে যাবে। তার চেয়েও বড় কথা, জীবনের শেষে এসে নিজের মুখোমুখি হতে পারব তো? যখন আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাকে প্রশ্ন করবে, কী করলে তুমি, তুমি কী দায়িত্ব পালন করলে? আমি এই প্রশ্নে নিরুত্তর থাকতে চাই না। জোর গলায় বলতে চাই, এই মহান বিশ্বের, এই মহৎ কর্মকাণ্ডে আমি ওই ইটখানি গেঁথে গেলাম। এ সেই অহম... আমি... এর থেকে মুক্তি পেলাম না!

কিরীটী সেনগুপ্ত: প্রকাশকের ভূমিকায় তুই অধিকতর ফলনশীল। বাংলা, ইংরেজি এমনকি সংস্কৃত ভাষাতেও বই প্রকাশ করেছিস তোর নিজস্ব প্রতিষ্ঠান হাওয়াকলের ব্যানারে। প্রকাশক হাওয়াকলের কর্ণধার বিতান চক্রবর্তী একজন সফল গল্পকার। সংবেদনশীল গদ্য লেখক। বহুচর্চিত গ্রন্থকারও। অথচ, বাংলা সাহিত্যের পরিমণ্ডলে বিতান চক্রবর্তী নাম উচ্চারণ মাত্রই লেখক-কবিমহল প্রকাশক বিতানকে চিহ্নিত করেন। তিনটে বই কি যথেষ্ট নয় লেখকের নাম সুস্থায়ী করতে? নাকি অন্য কিছু মনে হয় তোর?

বিতান চক্রবর্তী: এ এক গোলমেলে ব্যাপার। যে সমস্ত লেখক কেবলই লেখক, প্রকাশক নন, তারা দাবি করতে পারবেন যে তারা থেকে যাবেন? না, পারবেন না। প্রকাশনা আমার পেশা। সেখানে আমি আমার যথেষ্ট পরিশ্রম, মেধাকে কাজে লাগিয়ে আজ একটি ব্র্যান্ডের দিকে এগোচ্ছি। লেখা তো লেখকের পরিশীলনের জন্ম, তাতে দৃষ্টিই আসল। সে লেখকই পাঠকের হৃদয়ে থেকে যান যার দেখার দৃষ্টি ব্যপক, বিস্তৃত। আমি যখন লিখতে আসি, একই সাথে অনেক অনেক লেখক আসেন, হাজার হাজার, আজ তাদের সিকিভাগও পাঠকের মনে নেই। এটা প্রতি দশকেই থাকে। আবার বাংলায় অনেকে মনে করেন, যত লিখব তত পাঠক মনে রাখবে, যত অনুষ্ঠানে যাব তত স্টার হয়ে উঠবেন। ফলাফল হয় উলটো। বেশি লিখতে লিখতে জঞ্জাল হয়ে যায় বেশির ভাগ লেখা। পাঠক কেন, যে কেউই জঞ্জাল বাড়িতে বা মনে জমিয়ে রাখেন না। এই সহজ সত্যটাকেই আমরা অস্বীকার করি। আর সেই অস্বীকার থেকে আসে অহং। তখন আমরা আমার লেখা বাদে বাকি লেখাকে ফালতু বলে ফেলে দেই। দেগে দিই, অমুকের মাত্র একটা বই; ওরে বাবা, তমুকের এত বই, এত পুরষ্কার? অথচ, বইতে আসলে কী আছে সেটা ভাবি না। বিশ্বসাহিত্যে এমন বহু উদাহরণ আছে একটি বইতেই লেখক বিশ্ববন্দিত। বিশ্ব ছেড়ে দাও, ব্যাসদেব মহাভারতেই অমর হয়ে আছেন, তাকে আর কোনও মহাকাব্য লিখতে হয়নি। তার কারণ, আমরা লেখক হিসেবে কোনও অনুসন্ধান করেছি? আসলে কী জানো, লেখক বা শিল্পীরা হলেন টাওয়ারের অধিবাসী। ধরো, এই পৃথিবিটা একটা বিশাল মাঠ আর মাঠের মাঝ বরাবর এক বিশাল উঁচু পাঁচিল কেউ একজন বলে দিয়েছেন ওপারে ওত পেতে রয়েছে নির্ঘাত মৃত্যু। শিল্পীরা কী করেন, পাঁচিলের পাশে একটি টাওয়ার বানিয়ে ওপারটা দেখবার চেষ্টা করেন। আর শিল্পীর সারাজীবনের কাজ হল সেই টাওয়ারে উঠে বসা। আর আমরা কী করি, অর্ধেক উঠে পাঁচিলে চোখ আটকিয়ে কেবল নিজের প্রতিবিম্বকেই এঁকে চলি। আর এই টাওয়ারে চড়া কেউ তার একটি বইতেই করে ফেলতে পারেন, কেউ বা সারাজীবনেও পারেন না। এর ফয়সলা সময় করবে।

কিরীটী সেনগুপ্ত: লেখক ও প্রকাশক এই দুই সত্তা সমানভাবে আছে তোর মধ্যে। এই দুই সত্তার সংঘাত হয় নিশ্চয়। অনিবার্য এই দ্বন্দ্বের পরিণতি কী? 

বিতান চক্রবর্তী: ক্লান্তি। প্রবল ক্লান্তি। মাঝে মাঝে মনে হয় সব লাথি মেরে চলে যাই। কারণ, প্রকাশনা করতে এসে দেখেছি মানুষের অন্ধত্ব। সারাদিন তুমি কত কত কুয়োর ব্যাঙের সাথে চলতে পার! আমার বই হলে, তার প্রোমোশন হলে আমার লেখকদের (যাদের বই আমি প্রকাশ করেছি) মুখ ভার। তাদেরটা করছি না কেন? আর করতে চাইলেও মুশকিল, কুয়ো ছেড়ে বাইরের সমুদ্র দেখতে যাওয়ার পরিশ্রম তাঁরা করতে চান না। আরে ভাই, প্রকাশক কি ঠেকা নিয়ে বসে আছে নাকি যে লেখককে কাঁধে করে নিয়ে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেবে? লেখকের দায় নেই? আজ পাঠক লেখক খুঁজে নে না, লেখক পাঠক খোঁজেন। আর সমস্ত পাঠক লেখকের পাশের বাড়িতে থাকে না! হাওয়াকলে লেখকরা কিন্তু আসে আমার নিজের লেখা বইয়ের প্রোমোশনস দেখে। তারা ভাবেন যে বিতান চক্রবর্তীর বই ফ্রি-তে মার্কেটিং হয়ে যায়! যদি তাদের বলি, চলুন দাদা, দিল্লি, মুম্বাই, হায়দ্রাবাদ, নিদেনপক্ষে উত্তরবঙ্গে, তাদের মুখ শুকিয়ে যায়। কলকাতাতেই  বই সংক্রান্ত কোনও অনুষ্ঠান করতেবললে তাঁরা বলেন, আমার বইয়ের অনুষ্ঠান করে কোনও লাভ হবে? যখন নিজেরই নিজের উপর ভরসা নেই তখন কেন ভাই আমার উপর রাগ করা? আমি যখনরাজ্যের বাইরে যাই, ধরেই নিই পাঠক, সমালোচক সবাই ছুড়ে ফেলে দেবে আমার বইটা, আমার লেখাগুলো। আর এই সামান্য রিস্কটাই নিতে রাজি নন আমার অনেক লেখক। তাঁরা কিন্তু আমাকে গালি দিতে ছাড়েন না। আর আমার গালি খেতে ভালো লাগে না; আবার উত্তরও দিতে পারি না

কিরীটী সেনগুপ্ত: ২০১৬তে যখন হাওয়াকল ডট কম শুরু হল, অনলাইন পোর্টালের সাফল্য সম্পর্কে সন্দিহান ছিলি আমি জানি। অথচ দ্যাখ, দু-বছরেরও কম সময়ে ই-কমার্স অভূতপূর্ব সাফল্য নিয়ে এলো। দেশ-বিদেশ গ্রামে-গঞ্জে এখন হাওয়াকল ডট কমের মাধ্যমে বই পৌঁছে যাচ্ছে। পাঠক কিনছেন। প্রতিদিন নতুন নতুন পাঠক এই সুবিধে নিচ্ছেন। অনলাইনে বই সংগ্রহ করা সম্পর্কে তোর মতামত জানতে চাই সবিস্তারে।

বিতান চক্রবর্তী: প্রথমেই আমি একদমই সন্দিহান ছিলাম না, অনলাইন পোর্টাল সম্পর্কে। হ্যাঁ, আমি চাইতাম ফ্লিপকার্ট বা অ্যামাজনের মতো একটা পোর্টাল হোক।এখনও পারিনি, কারণ সেই পরিমাণে ইনভেস্টমেন্ট করতে পারিনি বলে। আমাদের পুঁজি অল্প। ২০১৪-সালের শেষের দিকে আমি ফেসবুকে একটি তর্কে জড়িয়ে পড়েছিলাম, কথা হচ্ছিল বাংলা বইয়ের পরিবেশন নিয়ে। আমার বক্তব্য ছিল, বাংলা বইয়ের পাঠক বাড়াতে গেলে অনলাইন ছাড়া গতি নেই। সেখানে একজন আমাকে তীব্র আক্রমণ করে বলেন, আরে মশাই, সারা ভারতের ভাবনা ছাড়ুন, আগে বাঁকুড়া, বীরভূমের কোণায় কোণায় বই পৌঁছান। সেদিন হেসেছিলাম। দ্যাখো, আজ কলকাতা থেকেই বাঙালিরা সরে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গায়; এরা একসময় বাংলা বইয়ের পাঠক ছিলেন। এবার তাদের খুঁজতে আমাদের কী করা উচি? সারা ভারতের প্রতি শহরে, গ্রামে, পাড়ায়-পাড়ায় বাংলা বইয়ের দোকান খুলব? যারা এমন ভাবেন বা যিনি সেদিন আক্রমণ করেছিলেন তিনি কি জানেন একটাএসট্যাব্লিশমেন্টের খরচ কত? তুমি জানো, যখন আমরা ই-কর্মাস শুরু করছি তখন প্রথমেই শিপিং পার্টনার হিসেবে বেছে নিই ইন্ডিয়ান স্পিড পোস্টকে। কারণ, একমাত্র এই সংস্থাই সারা ভারত তথা সারা বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে বই ডেলিভারি করতে পারেন। পেরেওছে। সম্প্রতি এমন এমন জায়গায় আমরা বই ডেলিভারি করতে পেরেছি যেখানে অ্যামাজন এবং ফ্লিপকার্ট ডেলিভারি করে না, করতে পারে না

কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। আমি স্যাটিসফাইড নই অন্য জায়গায়। এখনও আমাদের বহু লেখক নিজেরাই খুব একটা অনলাইনে স্বচ্ছন্দ নন। আজও আমাদের বহু লেখক আছেন যারা নিজেদের বইয়ের অনলাইন লিংকটুকু শেয়ার করেননি। আবার অনেকে আছেন যারা লিংক বলতে কী বলা হয় সেটাও জানেন না। লিংক শেয়ার করতে গিয়ে আমাদের ফেসবুক পেজ শেয়ার করেন। তারা এটুকু ভাবেন না তিনি যদি নিজে অনলাইন স্যাভি না হন, তাহলে তারা পাঠককে কীভাবে গাইড করবেন? আর যারা ভাবেন আমি লেখক, আমি কেন আমার পাঠককে গাইড করব, তাঁদের প্রতি আমার নিশ্চুপ দীর্ঘশ্বাস রইলো, দ্রুত ফসিল হওয়ার পথে চলেছেন। ভেবে দেখ, এর আগে কোন বাঙালি প্রকাশক আমেরিকা, ইংল্যান্ডে সরাসরি বিক্রি করেছেন? আজ হচ্ছে। আমরা কেবল সারাদিন সভা-সমিতি কাঁপাই, বলি, বাংলা বইয়ের পাঠক নেই। আরে পাঠক সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে। তাদের কাছে বই পৌঁছে দেওয়ার জন্য ওই সভামুখ্যেরা কী কী করেছেন? আনন্দ এক সময় এমন উদ্যোগ নিত, ফলে মনে করে দেখো ওই দশকগুলো আনন্দ-এর ধারে কাছে কেউ ছিলো কি? আজ আর বাংলা প্রকাশক হিসেবে আনন্দ সেই উদ্যোগ নেয় না; কেন, আমি জানি না। অথচ ইংরেজি প্রকাশক, পেঙ্গুইন সেটা করে। সারা বিশ্বের পাঠককে একত্রিত করেছে। আর আজও যদি বাংলা প্রকাশনা এটা ভেবে বসে থাকে তার পাঠক, মার্কেট কেবল কলেজ স্ট্রিট
 তাহলে তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। আমি মনে করি, আজকের প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বই-শিল্পকে একটা ইন্ডাস্ট্রিতে পরিত করা সম্ভব। আর তারও আগে একবার ভাবা উচিত, এই প্রেস শিল্পতে কত কত মানুষ জড়িয়ে আছেন, যদি প্রকাশক হিসেবে আমরা অসফল হই তাদেরও রুজিতে টান আসবে। একমাত্র নতুন ইনভেনশনই আমাদেরকে আজ বাঁচিয়ে তুলতে পারে।

কিরীটী সেনগুপ্ত: বই বিপননে মন দিতে দিতে নিজের সৃষ্টিশীল কাজ বিঘ্নিত হয়। এই অসুবিধার খেসারত কেবল লেখক বিতান চক্রবর্তীকে নয়, প্রতিটি লেখককে দিতে হয় যিনি বই প্রকাশনার সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত। সমতা বিধান করব বললেই করা যায় না। পেটের টান বড় বালাই। পাবলিশিংকেই যখন পুরোদস্তুর পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিস, নিজের লেখালিখিকে পর্যাপ্ত সময় দিচ্ছিস কীভাবে?

বিতান চক্রবর্তী: যাকে কোয়ালিটি টাইম বলে তা আর দিতে পারি কোথায়? যখন কলকাতার বাইরে যাই ট্রেন আমার প্রথম পছন্দ। কারণ, ওখানে একটি নিরবচ্ছিন্ন সময় পাই যেখানে আমি খানিক ভাবতে পারি। আর কলকাতার বাইরে থাকলে রাতে অন্তত চার ঘণ্টা পাওয়া যায় যখন চাইলেও আমি প্রকাশনার কাজ করতে পারব না, অফিস কম্পিউটার না থাকার জন্য; সেটাকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করি। আর কলকাতায় থাকলে কখনও কদাচিৎ কিছু সময় পেয়ে যাই, তখন লিখি। আর কখনও কখনও এমন হয়, লেখাটা না লিখতে পারায় আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি, তখন অফিস ছুটি নিয়ে লিখতে বসি। সেই সময় কিন্তু পাবলিকেশনের অনেক ক্ষতি হয়। এখানে একটা কথা বলি, আমি যখন পুরোপুরি লেখাতে থাকি শরীর খারাপ হয়, অসুস্থ হয়ে যাই, তাতে শেষ পর্যন্ত লেখাটা হয়ে যায় যাই হোক, সত্যি বলছি, এভাবে লেখা চলতে পারে না। আমাকে আমার নিজের জন্য দ্রুত একটা ম্যানেজমেন্ট তৈরি করতে হবেই।

কিরীটী সেনগুপ্ত: নতুন বছরে (২০১৮) তোর নতুন গল্পের বই প্রকাশিত হবে এমনটাই বলছিলি সেদিন। কী কী আশা করতে পারি আমরা, তোর পাঠকেরা? আর কী কী আশা করা যাবে না বলে দিলে মন্দ হত না।

বিতান চক্রবর্তী: নতুন বছরে আমার দ্বিতীয় গল্পের বই বের করতে চাই। আর আশা? একটাই আশাভাল লেখা। যেদিন ভাল লিখতে পারব না সেদিন বিদায় নেব। জোর করে লিখে জঞ্জাল বাড়াব না, পাঠককে ঠকাবো না, আর আলোতে থাকার জন্য অন্যের লেখা চুরিও করতে পারব না আমি।
 




২টি মন্তব্য:

Blogger দ্বারা পরিচালিত.